১৯ বছর পরও রমণ লাম্বাকে ভুলতে পারেননি পাইলট

২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮। আর দশটা দিনের মত সেদিনও পুব আকাশে সূর্য উঠেছিল। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে রোশনাই ছড়িয়ে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন ভারতের হয়ে চারটি টেস্ট আর ৩২টি ওয়ানডেতে প্রতিনিধিত্ব করা রমণ লাম্বা। তখন আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানে গোটা বাংলাদেশ দুই ভাগে বিভক্ত হওয়া। ম্যাচটিতে আবাহনীর জয় চাই-ই চাই। আবাহনীর বিদেশী নায়কের মনেও ছিল সেই একই আকুতি, অভিন্ন ইচ্ছা। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট মোহামেডানকে চাপে ফেলতে ক্লোজে আসতে বললেন ফিল্ডারদের। আপন দায়িত্ব মনে করে লাম্বা দাঁড়িয়ে গেলেন ফরোয়ার্ড শট লেগে।

‘আরে দাদা, তুমি যে হেলমেট নিচ্ছ না, হেলমেট নাও।’-কথাগুলো লাম্বার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন পাইলট। ‘দু-তিনটে বলের জন্য আর হেলমেটের কী দরকার।’ পাইলটকে বলেছিলেন লাম্বা। তারপরও জোর করেছিলেন পাইলট,‘ দাদা, হেলমেট নাও।’ এটুকু বলে নিঃশ্বাস ফেলেন পাইলট। গলাটা যে তার ধরে এসেছে। তারপর বলে গেলেন,‘ আমার ক্যাপ্টেন আকরাম (আকরাম খান) ভাই ইনজুরির কারণে মাঠে ছিলেন না। আসলে হয়েছে কী তার সঙ্গে আমার ওই বলের আগেও কথা হয়। আমরা খুব কম রান করেছিলাম। ওই রানেই আমাদের জিততে হবে অ্যাটাকিং ফিল্ডিং করে। ও (রমন লাম্বা) দেখি নিজ ইচ্ছায় ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়িয়ে গেল হেলমেট ছাড়াই। আমি বললাম, তুমি হেলমেট নিয়ে নাও। তখন ও বলল,‘ না, দু-একটা বলের জন্য কোন সমস্যা নেই।’

আপ্লুত পাইলট বলে যাচ্ছিলেন,‘ শট বল ছিল। অপি (মেহেরাব হোসেন) মেরেছে জোরে পুল শট। লাম্বার মাথায় লেগে বলটা এল আমি যেখানে কিপিংয়ের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম তার ঠিক পেছনেই। ক্যাচটি ধরে ফেলি। এবার বুঝুন বলটি কত জোরে তার মাথায় লেগেছিল। ওয়ালে বল লাগলে যেমন রিটার্ন আসে লাম্বার মাথায় লেগে তাই হয়েছিল।’

সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন লাম্বা। তবুও জ্ঞান হারাননি। পাইলট বলেন,‘ এরকম আঘাত পাওয়ার পরও সে সময় তার সেন্স কাজ করছিল। ও হেঁটে হেঁটে ড্রেসিংরুমে চলে গেল।’ তারপরের ঘটনা সবার জানা। ড্রেসিংরুমে ফেরার পর দুঃসহ যন্ত্রণা হচ্ছিল লাম্বার। ঢাকার একটি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু কোমায় চলে যাওয়া লাম্বাকে আর শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। জীবন-মৃত্যুর মাঝে তিনি থমকে ছিলেন তিন দিন। ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে লাম্বা চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

আজ ১৯ বছর পর এসেও লাম্বা পাইলটের কাছে জীবন্ত। ভারতের বাইরে যিনি বাংলাদেশকে বেঁধেছিলেন মায়ার বাঁধনে। সেই বন্ধুকে কী ভোলা যায়? পাইলটও চিরদিন মনে রাখবেন তার বিদেশী বন্ধুটিকে,‘ ওর কথা খুব মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকব চিরদিন ওকে মিস করব। ওর এভাবে চলে যাওয়াটা এখনও মানতে পারি না।’

১৯৯১ সাল থেকে মৃত্যু অবধি বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে আবাহনীর হয়ে খেলে গেছেন লাম্বা। সে সময় তিনি ছিলেন ক্রিকেটারদের কাছে স্বপ্নের নায়ক। লাম্বার চলনবলন সবাই অনুকরণ করত। ক্রিকেটাররা তাকে দেখে শেখার চেষ্টা করত। শুধু কী তাই, ওই সময় বাংলাদেশের মত একটি দেশে ক্রিকেট খেলে তিনি যে এদেশের ক্রিকেট উন্নয়নেও অবদান রেখেছেন। সেটা কী রকম শুনুন পাইলটের মুখেই,‘ ও হচ্ছে আমার দেখা সুপার একজন প্লেয়ার। একজন প্লেয়ার হিসেবে ওর কোনও তুলনা নেই। আমি খুব লাকি যে খুব কাছ থেকে তাকে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ও সবার কাছে ছিল দৃষ্টান্ত। তাকে দেখে অনেক কিছু শেখার ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ডেভলপমেন্টে লাম্বার অবদান অনেক। সেই সময় তার মত একজন প্লেয়ার বাংলাদেশে খেলে, এটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। তাকে আমরা ফলো করতাম। ও কিভাবে ব্যাটিং করে, কিভাবে শট খেলে এগুলো আমরা দেখতাম।’

যে লোকটা বাংলাদেশে খেলতে খেলতে নিজের জীবনই বিসর্জন দিয়ে গেলেন তার একটা ছবি না বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) না আবাহনী ক্লাব, কোথাও দেখে মেলে না! লাম্বাকে আমরা প্রাপ্য সম্মানটুকু দেখাতে পেরেছি? এরকম কথা তুলতেই শুধু আফসোসই করে গেলেন পাইলট,‘ সত্যি কথা বলতে কী আমরা ওর জন্য কিছু করতে পারিনি।

আমাদের ক্লাবের কালচার অন্যরকম। আমরা শুধু যৌবনের সময় প্লেয়ারদের ব্যবহার করি। যৌবন শেষ তো সব শেষ! আপনি দেখুন, মুন্না ভাই বাংলাদেশ ফুটবলের কিংবদন্তি। উনার আমলে উনি বাংলাদেশের এক নম্বর ফুটবলার ছিলেন। সেই মুন্না ভাইকে আমরা সম্মান দিতে পারি না! তাহলে কিভাবে আশা করব যে, আমরা রমণ লাম্বার মত মানুষকে সম্মান করব! মানুষ তো আসবে যাবে। কিন্তু একজন আরেকজনকে সম্মান করবে এটাই তো আমরা চাই।’

এখনকার প্রজন্ম রমণ লাম্বাকে চেনে না। দিন যত যাবে আরও তলিয়ে যেতে থাকবেন তিনি। কিভাবে ধরে রাখা যায় লাম্বার স্মৃতি? পাইলটের পরামর্শ,‘ আবাহনী ক্লাবে লাম্বা দীর্ঘসময় খেলেছেন। তাকে নিয়ে ছোট একটা বই করা যেতে পারে। যারা তার সঙ্গে খেলেছেন বা দেখেছেন তাদের কথা সেখানে তুলে আনতে হবে। আবাহনী ক্লাবে লাইব্রেরি থাকলে সেখানে ছবিসহ রমণ লাম্বার বইটি রাখা যেত। তাহলে মানুষ সহজেই লাম্বাকে জানতে পারত।’



মন্তব্য চালু নেই