১০ জাতীয় সমস্যার সমাধান মোবাইল অ্যাপসে

জাতীয় দশ সমস্যার সমাধানে নতুন উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো টানা ৩৬ ঘণ্টার ম্যারাথন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা তথা জাতীয় হ্যাকাথন। গত শনিবার ঢাকার ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে (আইডিইবি) শুরু হওয়া এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় এই হ্যাকাথনে বেরিয়ে এসেছে উদ্ভাবনী সমাধান। ১০টি জাতীয় সমস্যার সমাধান দিয়ে হ্যাকাথনে সেরা দল নির্বাচিত হয়েছে ১০টি দল। তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০ লাখ টাকার ইনোভেশন ফান্ড দিচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।

হ্যাকাথন বিশ্বব্যাপী একটি ম্যারাথন কোডিং হিসেবে স্বীকৃত বা বিবেচিত। এটি এমন এক আয়োজন যেখানে প্রোগ্রামাররা একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সম্মিলিতভাবে কোডিং বিষয়ে কাজ করে থাকেন। ডেভেলপার, ইনোভেটর বা প্রযুক্তি সংক্রান্ত উদ্ভাবক ও ডিজাইনাররা সাধারণত প্রতি পাঁচজনের একটি দল গঠন করে হ্যাকাথনে যোগ দিয়ে। তাঁরা মূলত নিজেদের উদ্ভাবন দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার সমাধান করে থাকেন। প্রযুক্তি খাতের ডেভেলপারদের দক্ষতার উৎকর্ষ বা নৈপূণ্য দেখানোর একটি চূড়ান্ত প্রদর্শনী হলো হ্যাকথন।

১০টি জাতীয় সমস্যার সমাধান

ট্রাফিক জ্যাম
অহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাভিটিবিডি দলের সদস্যরা ট্রাফিক জ্যাম সমস্যা সমাধানের জন্য দারুন এক উদ্ভাবনী মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেন। তাদের অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ক্যামেরার মাধ্যমে গন্তব্য স্থানের রাস্তার জ্যামের অবস্থা জানা যাবে। রাস্তায় বেশি জ্যাম থাকলে বিকল্প পথের পরামর্শ পাওয়া যাবে। এছাড়াও নির্দিষ্ট স্থান থেকে গন্তব্য স্থান অ্যাপ্লিকেশনে ইনপুট দিলে ওই পথে চলাচলকারী ব্যক্তিরা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে এই তথ্য দেখতে পারবেন এবং চাইলে তাকে লিফট দিতে পারবেন।

সাইক্লোন সেন্টার ম্যানেজমেন্ট
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির ছাত্রদের দল ইউ আই ইউ অ্যাম্বাসেডর সাইক্লোন সেন্টার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে দারুণ একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেন। তাদের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে দেশের সবগুলো সাইক্লোন সেন্টারের দায়িত্বরত ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হবে। এই ডাটাবেজ এর মাধ্যমে দুর্যোগ পরবর্তী কোন সাইক্লোন সেন্টারে বেশী ত্রান সহায়তা প্রয়োজন সেই তালিকা তৈরি হবে এবং সে অনুযায়ী সরকারি সহায়তা প্রদান করা হবে। এছাড়াও অ্যাপ্লিকেশনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে দুর্যোগ পূর্ববর্তী বিভিন্ন সতর্কতার এস এম এস পাওয়া যাবে।

দুর্নীতি
দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ট্রিলিয়ন পিক্সেল একটি উদ্ভাবনী অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেন। দুর্নীতির সম্ভাবনা আছে এমন যে কোন স্থানে তাদের অ্যাপ্লিকেশনটির নির্দিষ্ট অপশনে প্রেস করলে অ্যাপ্লিকেশনটি অডিও রেকর্ডার হিসাবে কাজ শুরু করবে। এই অডিও ফাইলটি নির্দিষ্ট সার্ভারে জমা হবে এবং কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করবেন। অডিও ফাইলটি চাইলে ফেসবুক বা টুইটারে শেয়ার করা যাবে।

১০ জাতীয় সমস্যার সমাধান মোবাইল অ্যাপসেযৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা
ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলোজি অ্যান্ড সায়েন্স দলের নির্মিত আপন কথা নামক মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারা যাবে। বয়সন্ধিকালে পিতা মাতার দায়িত্ব, ছেলেদের স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন ও করণীয়, মেয়েদের বয়সন্ধিকালে স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন ও করণীয়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা এবং বয়সন্ধিকালীন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার ভিডিও পাওয়া যাবে অ্যাপ্লিকেশনটিতে।

অসংক্রামক রোগ
পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি দলের নির্মিত সুস্বাস্থ্য নামক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। অ্যাপ্লিকেশনটির মাধ্যমে হৃদরোগ, ক্যানসার, শ্বাসরোগ, ইত্যাদি জটিল রোগর লক্ষণ, কারণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা যাবে। বিভিন্ন লক্ষণ ইনপুট দিয়ে রোগ আছে কিনা অথবা রোগের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানা যাবে। ওষুধ বিষায়ক সহায়তা এবং মিনি প্রেসক্রিপশন পাওয়া যাবে। ফিজিক্যাল ডিভাইস দিয়ে ডায়াগনস্টিক রেজাল্ট ইনপুট দিলে মেডিকেল সাজেশন পাওয়া যাবে। জরুরি নম্বরে প্রেস করলে জিও লোকেশনসহ ইমার্জিন্সি কন্টাক্ট নম্বরে ফোন চলে যাবে।

স্বাস্থ্য সম্মত আচরণগত পরিবর্তন
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় দলের তৈরি স্বাস্থ্যকথা নামক এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত আচরণগত বিভিন্ন পরিবর্তনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের চিত্র পাওয়া যাবে। দুইধাপে অ্যাপ্লিকেশনটি কাজ করবে। রোগে আক্রান্ত যে কেউ তার রোগমুক্তির উপায় জানতে পারবেন এখান থেকে। আবার রোগে আক্রান্ত নয় কিন্তু লক্ষণ দেথা যাচ্ছে এমন ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো ইনপুট দিলে ফলাফল পাওয়া যাবে এবং করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ পাওয়া যাবে।

নিরাপদ নৌ-পরিবহন
নিরাপদ নৌ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত অ্যাপ্লিকেশন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেফটি। এই অ্যাপ্লিকেশনটির মাধ্যমে যাত্রী লঞ্চের তালিকা থেকে নির্দিষ্ট লঞ্চটি নির্বাচন করলে তার ফিটনেট রিপোর্ট দেখতে পাবেন। সঙ্গে নির্দিষ্ট দিন এবং সময়ে যাত্রী তার গন্তব্যস্থলটি ইনপুট করে সে দিনের আবহাওয়া এবং সে নৌপথ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানতে পারবেন। কেন্দ্রীয় ডাটাবেজে নৌ কর্তৃপক্ষ নৌপথ সংক্রান্ত সর্বশেষ পরিস্থিতি আপডেট রাখবে। পাশাপাশি কোন জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে হট কি প্রেস করে জরুরী যোগাযোগ সম্পাদন করা যাবে। অ্যাপ্লিকেশনটি নির্মান করে ব্রেইন স্টেশন ২৩।

প্রশ্নপত্র ফাঁস
‘দ্য গার্ড’ অ্যাপ্লিকেশনটির মাধ্যমে জেএসসি/ পিএসসি/ এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীগণকে স্বতন্ত্র কিউআর কোডের ভিত্তিতে সনাক্ত করা যাবে। এর ফলে একজনের পরীক্ষা অন্য কেউ দিয়ে দিতে পারবে না। পাশাপাশি শিক্ষকদের কাছে রাখা ডিভাইসের মাধ্যমে ব্লুটুথ, ওয়াইফাই এবং মোবাইল ডিভাইস ট্র্যাক করা যাবে। পরীক্ষা চলাকালীন কোনো অনৈতিক আচরণ ধরা পড়লে তা সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকের মোবাইলে প্রদর্শিত হবে। অ্যাপ্লিকেশনটি নির্মাণ করে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা।

যৌন হয়রানি
রূপম আইটি লিমিটেডের (এমএএসটি) নির্মিত ডাক অ্যাপ্লিকেশনটির মাধ্যমে একজন গ্রাহক জরুরি যোগাযোগের নম্বরসমূহ ইনপুট করে রাখতে পারবেন। পাশাপাশি কোনো সমস্যা হলে হট কি প্রেস করে একটি ‘ফেক কল’ করতে পারবেন। এছাড়া ইমার্জেন্সি বাটন প্রেস করলে আশেপাশের অ্যাপ ইউজাররা বিপদগ্রস্তার জিও লোকেশনসহ একটি অ্যালার্ট মেসেজ পাবেন। ফলে বিপদকালীন পরিস্থিতি সহজে কাটিয়ে ওঠা যাবে। এছাড়াও অ্যাপ্লিকেশনটিতে বিভিন্ন সেবাপ্রদানকারী এজেন্সি এবং পুলিশের নম্বর পাওয়া যাবে।

সড়ক নিরাপত্তা
মোবিওম্যান নির্মিত এই অ্যাপ্লিকেশনটির মাধ্যমে জরুরি অবস্থায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং হাসপাতালগুলোতে ইমার্জেন্সি সাহায্যের জন্য আবেদন করা যাবে। অ্যাপ্লিকেশনটির মাধ্যমে জিআইএস লোকেশনসহ প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা সেবা প্রদানকারী সংস্থার কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে। এ ছাড়াও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি জরুরি মুহূর্তে প্রাথমিক চিকিৎসার নির্দেশনা পাবেন।

হ্যাকাথনের সমাপনীতে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থাপতি ইয়াফেস ওসমান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম সচিব জনাব শ্যামা প্রসাদ ব্যাপারী, ইন্সটিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স এর সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার একেএমএ হামিদ, কিউবির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ডিএস ফয়সাল হায়দার, ইএটিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মুবিন খান, বিডি ভেঞ্চার লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত হোসাইন এবং প্রকল্প পরিচালক মিনা মাসুদ উজ জামান।

সমাপনী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এমসিসি লি. এর নির্বাহী পরিচালক আশ্রাফ আবির।

জনগণের মতামত ও বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় এই হ্যাকাথনের জন্য ১০টি জাতীয় সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। সম্মেলনে এক হাজার ৭০০ প্রোগ্রামার, ফ্রিল্যান্সার, শিক্ষার্থী, অ্যাপনির্মাতা ৩৪০টি টিমে বিভক্ত হয়ে অংশ নেন। পাশাপাশি ৪৯টি পেশাদার কোম্পানি অংশ নেয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আয়োজনে হ্যাকাথন বাস্তবায়ন করেছে এমসিসি লিমিটেড। সহযোগিতায় ছিল ইএটিএল, বেসিস, সিম্ফোনি, গ্রামীণফোন, রবি, সোলকোয়েস্ট, গুগল ডেভেলপার গ্রুপ, বেটার স্টোরিজ ও বিডি ভেঞ্চার লিমিটেড।

এই আয়োজনে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সহায়তা দিয়েছে কিউবি।



মন্তব্য চালু নেই