হেফাজতে ঈমান নামের একটি সংগঠনের দাবির মুখে লালন ভক্তদের অনুষ্ঠান বন্ধ

নেত্রকোণায় হেফাজতে ঈমান নামের একটি সংগঠনের দাবির মুখে লালন অনুসারীদের একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। ওই অনুসারীদের বিরুদ্ধে এলাকায় লিফলেটও বিতরণ করা হয়েছে।

যদিও এই ঘটনায় কোন মামলা হয়নি, তবে পুলিশ বলছে, এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতেই তারা এই ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এসব ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন লালন ভক্তরা।

নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার বাসিন্দা আবদুল হালিমের বাড়িতে লালন ভক্তদের নিয়মিত আসর বসতো, যেখানে লালন গানের বাইরে নানা বিষয়ে আলোচনা হতো।

কিন্তু কিছুদিন ধরেই সেই অনুষ্ঠান বন্ধের দাবি করে আসছিল স্থানীয় হেফাজতে ঈমান নামের একটি সংগঠন। তাদের দাবির মুখে সেই অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয় স্থানীয় পুলিশ। এরপর তাদের বিরুদ্ধে লিফলেটও ছড়ানো হয়।

আবদুল হালিম বলছেন, এরপর থেকেই তারা ভীতির মধ্যে রয়েছেন। প্রতিবছর ৩০ নভেম্বর আমার বাড়িতে লালন সাঁইজির গানের আসর বসে। কিন্তু এবছর একটি মহল কিছুদিন ধরেই এই আসর না করার জন্য বলে আসছিল। তারা ইউএনওর কাছে একটি আবেদনও করে।

তিনি বলেন, এরপর থানার কর্মকর্তারা আমাদের অনুষ্ঠান না করার জন্য বলে যায়। না হলে ঝগড়ঝাঁটি হতে পারে। কয়েকদিন পর আমাদের বিরুদ্ধে একটি লিফলেটও বিতরণ করা হয় যে, আমরা নাকি অ-ইসলামিক কাজ করি। কেন জয় গুরু বলি, এরকম কথা নাকি ইসলামিক অনুভূতিতে আঘাত করে। সেখানে কাফের মুরতাদ বলা হয়, বলা হয় যে আমাদের এই দেশের মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে।”

গত বছরও এই অনুষ্ঠানটি বাতিলের একদফা চেষ্টা করা হয়। তবে হেফাজতে ঈমানের কোন সদস্যের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় একজন সংবাদকর্মী জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর থেকেই লালন ভক্তদের মধ্যে ভীতি রয়েছে।

তবে কারো দাবির মুখে লালন ভক্তদের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায়, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে, কেন্দুয়া থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলছেন, এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই তারা ওই পদক্ষেপ নিয়েছেন।

সিরাজুল ইসলাম বলছেন, লালন ভক্তদের একটি গ্রুপ অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছু আলেম ওলামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন, যে তারা ইসলাম মানে না, তাদের যেন অনুষ্ঠান করতে দেওয়া না হয়।

তিনি জানান, সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গের আশংকা আছে, তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে আমরা তাদের অনুষ্ঠান না করার জন্য বলি। আর লিফলেটে কারো নাম উল্লেখ করা নেই, যে কারণে কাউকে এককভাবে ধরতে পারিনি। তবে যারা অনুষ্ঠান না করার কথা বলেছিল, তাদের আমরা চাপ দিয়েছি। তারা বলেছে, এখানে কোন বিশৃঙ্খলা হবে না। এ ঘটনায় থানায় কোন মামলা বা সাধারণ ডায়রিও হয়নি।

এর আগে লালন ভক্তদের উপর হামলার ঘটনার ঘটেছে মেহেরপুরে, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী, নাটোরের সাধুসঙ্গে । কয়েকটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও, হামলাকারীদের শাস্তির এখনো কোন নজির নেই। যদিও বাংলাদেশের সংস্কৃতি সচিব আকতারী মমতাজ বলছেন, বাউলদের অধিকার রক্ষায় তারা সচেষ্ট রয়েছেন।

আকতারী মমতাজ বলছেন, এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও ভূমিকা রাখার সুযোগ বেশি। ‘তবে অনেক জায়গায় সত্যিই বাউলরা আক্রান্ত হয়েছে। একটা গোষ্ঠী তো তৎপর আছে। তবে আমরা বাউলদের অধিকার সংরক্ষণে, তাদের চর্চা অব্যাহত রাখায় কাজ করে যাচ্ছি।

কিন্তু এই বক্তব্যে অবশ্য সন্তুষ্ট নন বাউল পাগলা বাবলু। তার মতে, একের পর এক বাউলদের উপর হামলার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তা বন্ধে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পাগলা বাবলু বলছেন, একটা ভয় তো শুধু বাউলের ভেতরে না, আমাদের সবার মধ্যে রয়েছে।

”কষ্টটা হইতাছে, যেখানে লালন বলছেন, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সেখানে এখনো যদি এরকম ঘটনা ঘটে, তাতে শুধু বাউল ব্যথিত হয় না, আমার মনে হয় গোটা মানবজাতিটাই ব্যথিত হয়।”

লালন শাহের গানের উদ্ধৃতি দিয়ে বাউল পাগলা বাবলু বলেন, ”ঠিক পথে চলরে আমার মন, পরের নারী, পরের দ্রব্য হরণ করো না, কিন্তু এটাও তো হরণ হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্নভাবে হরণ হয়ে যাচ্ছে।”

তবে পাগলা বাবলু বলছেন, তাদের প্রতি যত হুংকার বা হুমকি আসুক না কেন, তা তাদের বাউল গান বা লালন চর্চায় কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। সেই সঙ্গে বাউলদের নিরাপত্তায় সরকারকে আরো উদ্যোগী হওয়ারও দাবি জানিয়েছেন তিনি। বিবিসি বাংলা



মন্তব্য চালু নেই