হিলারি-পুতিন দ্বন্দ্বের নেপথ্য কাহিনী

বর্তমান বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুরো দুনিয়ার নজর থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। স্নুায়ুযুদ্ধের অবসান হলেও বিশ্বের মোড়লগিরিতে রাশিয়া এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। বলা যায় একে অপরের ‘প্রধান শত্রু’। অথচ এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিতর্কিত বিষয়ের মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে রাশিয়া। আরও সহজ করে বললে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছেন। এ অভিযোগ উঠে উইকিলিকস কর্তৃক হিলারি ক্লিনটন ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ই-মেইল ফাঁস হওয়ার পর। নির্বাচনে হস্তক্ষেপ বলতে আসলে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করছে, হিলারি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ই-মেইল ফাঁস করেছে রাশিয়া। এটা প্রমাণ করে, পুতিন চাইছেন হিলারির পরিবর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আর ট্রাম্পও ওবামার চেয়ে পুতিন যোগ্য বলে এই বিতর্কে ঘি ঢালেন। ফলে মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব’ সামনে চলে এসেছে।

হিলারি ও পুতিনের দ্বন্দ্বের নেপথ্য কারণ নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। তাতে ওঠে হিলারি ও পুতিনের দীর্ঘদিনের পরস্পরবিরোধিতা ও দ্বন্দ্বের কথা।

পুতিনের সঙ্গে হিলারির বিরোধের সূত্রপাত প্রথম প্রকাশ পায় ২০১৩ সালে। হিলারি তখন ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর পুতিন তখন রুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। হিলারি তখন কিভাবে পুতিনকে মোকাবেলা করা হবে সে বিষয়ে ওবামাকে পরামর্শ দিয়ে একটি নোট পাঠান। ওবামার প্রতি পুতিনকে নিয়ে হিলারির স্পষ্ট বার্তা ছিলো: পুতিনকে ধমকের ওপর রাখো। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের নিয়ে লেখা হিলারির স্মৃতিচারণমূলক বই ‘হার্ড চয়েজ’-এ এই নোটের কথা উল্লেখ করেছেন হিলারি।

২০১৪ সালে হিলারি স্মৃতিচারণ অনুসারে হিলারি প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অনুরোধ জানান, একত্রে কাজ (পুতিনের সঙ্গে) করার বিষয়ে বেশি আগ্রহ না দেখানোর জন্য। উচ্চ পর্যায়ে পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় গলে যাবেন না। প্রেসিডেন্ট পর্যায়ে বৈঠকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন না।

মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ কূটনীতিক হিলারির এমন পরামর্শ ছিলো অপ্রত্যাশিত। স্বাভাবিকভাবেই ওবামা এসব পরামর্শের বেশিরভাগই অগ্রাহ্য করেছেন। তবে এ পরামর্শেই হিলারি সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত অবস্থান তৈরি হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের। আর তা হচ্ছে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক প্রচণ্ড সংশয় ও তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে। আর পুতিনকে নিয়ে হিলারির অবস্থান দাঁড়ায়, পুতিন হচ্ছেন সেই মানুষ; যার সঙ্গে শুধু শক্তি প্রদর্শনের ভাষায় কথা বলা যায়।

ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া বিষয়ক নীতি নির্ধারণে জড়িত সাবেক ও বতর্মান কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সালে পুতিন পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ছিল হিলারির জন্য হতাশার। কারণ পুতিন নির্বাচিত হওয়ার পরই মস্কো ও ওয়াশিংটনের সহযোগিতার সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পরই হিলারি ঘোষণা দিয়েছিলেন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার। হিলারি প্রকাশ্যে পুতিন সরকারের ভোটে কারচুপি ও সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে সমর্থনের সমালোচনা করেন।

দীর্ঘদিন ক্রেমলিনকে পর্যবেক্ষণকারীরা মনে করেন, পুতিনও হিলারিকে ছেড়ে কথা বলেননি। প্রায় সময়ই ব্যক্তিগতভাবে হিলারিকে আক্রমণ কূটনীতিক সংকট তৈরি করেছে। এ বাগযুদ্ধ পুতিন-হিলারির মধ্যে বিরোধের জন্ম দিয়েছে। এর ফলেই ক্রেমলিন হিলারি ও তার দলের সদস্যদের ই-মেইল হ্যাক করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারির শেষ সময়ে মস্কোতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মাইকেল ম্যাকফাউল বলেন, তার (হিলারি) এমন নীতি ও ঘটনা রয়েছে যা রাশিয়ানরা পছন্দ করে না। এটা ভুলে যাওয়া হয় ট্রাম্প ও পুতিন নিয়ে বেশি আলোচনার কারণে। কিন্তু তাদের এ ইতিহাস বাস্তব এবং পুতিন এসব ঘটনা ভোলেননি।

পুতিন সম্পর্কে হিলারির শক্তিশালী অবস্থান প্রথম প্রকাশ পায় ২০০৯ সালে, যখন তিনি ওবামা প্রশাসনে প্রথমবারের মতো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। মার্কিন সিনেটর হিসেবে তিনি ২০০৮ সালের আগস্টে জর্জিয়াতে রুশ সামরিক অভিযানের নিন্দা জানান। হিলারি তখন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র কর্মকর্তা ও তৎকালীন রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়াকে অতীতের মতো আধিপত্যবাদী শক্তিতে পরিণত করবেন।

২০০১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ পুতিনকে চরিত্রায়ন করে বলেছিলেন, তিনি রাশিয়ানের চোখে তাকিয়ে তার হৃদয় সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। কিন্তু হিলারি ক্লিনটন ২০০৮ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতার লড়াইয়ের শুরুতে বলেছিলেন, পুতিনের হৃদয় বলে কিছু নাই আসলে। হিলারি বলেন, তিনি (পুতিন) ছিলেন কেজিবি এজেন্ট- যাদের আসলে কোনও হৃদয় থাকে না।

এরপর সবাইকে আশ্চর্য করে ওবামা হিলারিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল ওয়াশিংটন ও মস্কোর সহযোগিতার নতুন যুগ শুরু হবে। হোয়াইট হাউসের নতুন প্রশাসন ভেবেছিল, রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের চেয়ে ১৩ বছর কম বয়স ও সোভিয়েত আমলাতন্ত্র সম্পর্কে কম অভিজ্ঞ পুতিনের সঙ্গে সত্যিকারের অংশীদারিত্বের সুযোগ তৈরি হবে।

ওই সময় রুশবিষয়ক মার্কিন নীতি নির্ধারণ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউসের যেসব কর্মকর্তা শুরুর দিকের বৈঠকে অংশ নিয়েছেন তারা জানান, হিলারি প্রথমদিকে এতে সম্মত ছিলেন। কিন্তু তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তিনি মনে করতেন, সুযোগ পেলেই রাশিয়া নিজেদের স্বার্থ ছাড়িয়ে কিছু বিষয়ে সম্পর্ক বাড়াতে চাইবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির ইউরোপ ও ইউরেশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফিলিপ গর্ডন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করার ধারণা ছিল প্রেসিডেন্টের (ওবামা)। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে আমরা খারাপ অবস্থায় আছি বলে যৌক্তিক অবস্থানও ছিল। নিজেদের স্বার্থে এ বিষয়ে কোনও সুযোগ পেলে আমরা তা কাজে লাগিয়েছি।

আরেক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, পুতিন সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকে পুতিনকেই আসল নেতা হিসেবে মনে করতেন। ক্রেমলিনের শাসন কাঠামো সম্পর্কে ধারণাগত ভুলের কারণে মেদভেদেভকে কোণঠাসা করার সিদ্ধান্ত নেন ওবামা। পর্যবেক্ষকরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পুতিনের কঠোর ও আক্রমণাত্মক মনোভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন।

রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের হয়ে রুশবিষয়ক নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে সন্দেহ সঠিক ছিল। বিশ্বকে দেখার দৃষ্ঠিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে এখনও কাঠামোগতভাবে আমাদের রাশিয়া বিষয়ে অনেক কিছুতেই আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়।

এছাড়া মার্কিন প্রশাসন যখন ২০০৯ সালে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় শুরু করার ঘোষণা দেয় তখনও তাতে গুবলেট বাধে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের কাছে হিলারি পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তাতে হিলারি ইংরেজি ‘রিসেট’ শব্দের রুশ ভাষান্তর ব্যবহার করেন ‘পেরেগ্রুজক’। যা ছিল একটি বড় ভুল। রুশ ভাষায় এ শব্দের অর্থ হলো ‘অতিরঞ্জিত’। এতে ল্যাভরভ বিরাট ভুল ধারণা পান।

এর এক বছর পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কন্ডোলিসা রাইসের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। রাইস ছিলেন হিলারির পরবর্তী পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সন্দেহ থাকলেও ওবামা প্রশাসনের এ পরিকল্পনা শুরুতে কিছু সাফল্য নিয়ে আসে। তার এক বছরের মধ্যে উভয় দেশের সরকার বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।

২০১১ সালে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টি নির্বাচনে জয়লাভ করে দেশটির পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পর্যবেক্ষকরা ওই নির্বাচনকে সাজানো বলে দাবি করে আসছেন। হাজার হাজার রুশ নাগরিক প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। হোয়াইট হাউসের পক্ষে হিলারি প্রতিবাদকারীদের সমর্থন জানান এবং ভোটে কারচুপির জন্য রুশ প্রশাসনের সমালোচনা করেন। এ সমালোচনার এক মাস পর লিথুয়ানিয়াতে দেওয়া এক ভাষণেও তিনি রুশ নাগরিকদের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন পাওয়ার অধিকার রয়েছে বলে দাবি করেন। এই ভাষণের পর মস্কোতে যখন প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন পুতিন তার রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, তারা হিলারির আদেশে ও সমর্থনে প্রতিবাদ করছে। ২০১২ সালে পুনর্নিবাচিত হওয়ার আগেই পুতিন আরও বেশি কঠোর ও স্বৈরাচারী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

একই সময়ে হিলারি ক্লিনটনও পুতিনের পুনরায় ক্ষমতা আসা নিয়ে হোয়াইট হাউসকে সতর্ক করে আসছিলেন। তিনি দাবি করে আসছিলেন, পুতিন পুনরায় নির্বাচিত হলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। যেমন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ছিল সহিংসতার শুরু এবং উদ্ভুত পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জিহাদিদের পক্ষে যায়।

এরপর ২০১১ সালের পর থেকে সিরিয়া নিয়ে রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্বও প্রকট হয় কিছুটা। বেশকিছু বিষয়ে দুই দেশের মতপার্থক্য গুরুতর আকার ধারণ করে। আর কূটনৈতিক সম্পর্কও অনেকটা ব্যক্তিগত হয়ে পড়ে।

ফলে এখন হিলারি যখন এখন হোয়াইট হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন; তখন পুতিন স্বাভাবিকভাবেই হিলারিকে খাটো করতে তার ক্ষমতা কাজে লাগাচ্ছেন বলে মনে করেন ইউরোশিয়া কনসালটিং গ্রুপের চেয়ারম্যান ও রাশিয়া বিশেষজ্ঞ ক্লিফর্ড কাপচান। তিনি বলেন, রুশ পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে দাঙ্গার পর হিলারির বক্তব্য ছিল, আগুনে কেরোসিন ঢালার মতো, যা পুতিনকে সত্যিকার অর্থে রাগিয়ে দিয়েছে।

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট।



মন্তব্য চালু নেই