হিজড়াদের ‘ভালো জীবন’ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ

মানব সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী হিজড়াদের ‘ভালো জীবন’ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। নগরীর ১৬ থানায় বসবাসরত হিজড়াদের তালিকা করে তাদের পুর্নবাসন করার পাশাপাশি তাদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সিএমপির একাজে সমাজের বিত্তশালী ও শিল্পপতিদের সম্পৃক্ত করার চিন্তা ভাবনা করছে সিএমপি।

বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিএমপির এ উদ্যোগের ফলে সমাজের এক শ্রেণীর কাছে চরমভাবে অবহেলিত ও নিগৃহিত তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষও সমাজে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। পাশাপাশি তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধও অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ লক্ষ্যে নগরীর প্রায় ৩ শতাধিক হিজড়ার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে সিএমপি কার্যালয়ে এক বৈঠকে বসছেন সিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তারা। গত রোববার থেকে সিএমপির ১৬ থানার ওসিদের মাধ্যমে এই তালিকা তৈরি করে সিএমপি। মঙ্গলবার সিএমপির মাসিক অপরাধ বিষয়ক সভায় বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল মন্ডল,দুই অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, সকল উপ-পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, সহকারি পুলিশ কমিশনার এবং ১৬ থানর অফিসার ইনচার্জগণ

বিষয়টি নিশ্চিত করে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিড়িয়ে থাকা হিজড়াদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তারা স্বাভাবিক জীবন মেনেও চলতে পারছেনা। ফলে সমাজে তারা কোনো চাকরিও পাচ্ছেনা। আবার সমাজে তারা নানা ভাবে অবহেলিত ও নিগৃহিত হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘হিজড়াদের স্বাভাবিক জীবন দিতে সিএমপির পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৬ থানার ওসিদের মাধ্যমে একটি তালিকা করা হয়েছে। প্রায় তিন শতাধিক হিজড়ার তালিক প্রস্তুত করা হয়েছে। সমাজের বিত্তশালী ও শিল্পপতিদের সহযোগিতায় হিজড়াদের পুর্নবাসন করা হবে। পাশাপাশি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে তাদের কাউন্সিলিং করা হবে। এ লক্ষ্যে আগামী বৃহস্পতিবার সকালে সিএমপি কার্যালয়ে হিজড়াদের নেতাদের সাথে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।’

সিএমপি সূত্রে জানা যায়, নগরীর খুলশী থানার ঝাউতলা, আমবাগান, সেগুনবাগান, ওয়ার্লেস, কোতোয়ালী থানার ফিরিঙ্গি বাজার, লাভলেইন, কাজির দেউড়ী, পাহাড়তলী থানার সিডিএ, আকবরশাহ থানার নিউ শহীদ লেইন, বাকলিয়ার তুলাতলী, রাজাখালীসহ অন্যান্য থানা এলাকাতেও এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে হিজড়াদের বসবাস রয়েছে।

নগরীর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত হিজড়ারা দল বেঁধে সেজেগুজে টাকা তুলতে দেখা যায়। কাঙ্খিত টাকা না পেলে জোর করে কিংবা সম্মানহানি করে টাকা আদায় করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগও রয়েছে হিজড়াদের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে থানা পুলিশের কাছে হিজড়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে তারাও এ বিষয়ে বিড়ম্বনা এড়াতে কোনো পদক্ষেপ নেয়না।

এসব কারণে হিজড়াদের সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত করতে তুলতে এবং তাদের সৃশৃঙ্খল জীবন-যাপন নিশ্চিত করার এ পরিকল্পনা নিয়েছে সিএমপি। ইতোমধ্যে সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে ১৬ থানার ওসি নগরীর বিভিন্ন হিজড়া সমিতির সহযোগিতায় একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন। বৃহস্পতিবার সকালে হিজড়াদের সাথে বৈঠকে তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা নেবে পুলিশ।

তারপর নগরীর বিত্তবান, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ সামাজিক কর্তব্য পালনে সামর্থ্যবানদের নিয়ে মতবিনিময় করা হবে। বিত্তবানদের সহায়তায় সকলের সাথে পরামর্শক্রমে যত দ্রুত সম্ভব হিজড়া সম্প্রদায়কে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হবে। এতে করে মানুষ হিসেবে এই শ্রেণির লোকেরা যেমন নিজেদের মূল্যায়ন পাবে, তেমনি বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাবে নগরবাসী। এমনটিই মনে করছেন সিএমপির শীর্ষ কর্মকর্তারা।

বাকলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘অনেক সময় হিজড়াদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা নিয়ে অনেকে থানায় আসে। আবার অনেকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়েও থানায় আসে। তবে এদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমরা বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সমাধানের পরামর্শ দেয়। এখন সিএমিপর এই উদ্যোগের ফলে হিজড়ারা তাদের জীবনকে স্বাভাবিক করতে পারবে বলে আশা করছি। আমার বাকলিয়া থানা থেকে ১৫ জনের একটি তালিকা করে সিএমপিতে জমা দিয়েছি।’

নগরীর বেশিরভাগ হিজড়া অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত খুলশী থানার ওসি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘নগরীর বেশিরভাগ হিজড়াদের সমিতির শীর্ষ স্থানীয়রা আমার থানা এলাকায় বসবাস করে থাকেন। ফলে সিএমপির এই উদ্যোগকে সফল করতে আমরা তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। তারাও আমাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। খুলশীতে ৭৫ জনের একটি তালিক তৈরি করা হয়েছে।’

বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে মন্তব্য করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাজতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক লুৎফুন নাহার বেগম বলেন, ‘সিএমপির এই উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তাদের এই উদ্যোগ সফল হলে আমরা যাদের হিজড়া নামে চিনি বা ডাকি তারা সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবে। তারা মানুষের কাছে হাত না পেতে কাজ করার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ পাবে। তারাও সমাজে সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে চলার সুযোগ পাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সামাজিক ব্যবস্থার কারণেই তারা নিজস্ব ঢংয়ে নিজস্ব জগৎ নিয়ে বসবাস করছে। কিন্তু তাদের এই লিঙ্গ বৈষম্যের জন্য তারা দায়ী নয় এটা একটি জিনগত ব্যাপার। এরপরও আমাদেরই কাছের কেউ এই সমস্যার কারণে আমাদেরই অবহেলার পাত্র হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া তারা নিজেদের কাজে নিয়োজিত করলে তাদের বিরুদ্ধে চাঁদা নেয়া বা বিভিন্ন মাদক ব্যবসার যে অভিযোগ রয়েছে সেটিও দূর হবে।’

হিজড়াদের বিষয়টিকে মানবিকভাবে দেখা উচিত এবং সিএমপির এই উদ্যোগকে সকলের সহযোগিতা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সমাজতত্ত্ব বিভাগের এই শিক্ষক।

প্রসঙ্গত, হিজড়া বলতে ভারতের ট্রান্সসেক্সুয়াল বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে বুঝানো হয়ে থাকে; যাদের দৈহিক গঠন ছেলে বা মেয়ে কোনো শ্রেণিতে পড়েনা। জিন এবং ক্রোমোজম সংক্রান্ত ত্র“টির কারণে হিজড়া সন্তান জন্ম নেয়। নারী-পুরুষের মাঝামাঝি একটি দৈহিক অবয়ব নিয়ে জন্ম নেয়া এসকল মানুষ সাধারণ মানুষের সাথে তেমন মিশতে পারেননা।



মন্তব্য চালু নেই