হারাতে বসেছে বাঙালির শাঁখার ঐতিহ্য

মেঘলা আকাশ মাথার ওপর রেখেই হাঁটতে হাঁটতে ঢাকার ইসলামপুর, বাবু বাজার হয়ে শাঁখারি বাজার। উদ্দেশ্য ঐতিহ্যের পুরান ঢাকার শাঁখাশিল্প। বাংলাদেশের বৃহৎ এই শাঁখা-সিঁদুর শিল্প পল্লী থেকে সমগ্র দেশের গ্রাম-গঞ্জে পৌঁছে যাচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির আদিম এই শিল্প পণ্য।

হিন্দু ধর্মীয় বৈবাহিক রীতির একটি অলঙ্কার। হাতের বালার মতো এই অলঙ্কার বিবাহিত হিন্দু নারীরা ব্যবহার করেন। বিবাহের মন্ত্র পড়ার সময় কনের পিতা কনের হাতে দুটি শাঁখা দিয়ে থাকেন, স্বামীও স্ত্রীর জন্য শাঁখা কিনে আনেন। হিন্দু রমণীরা তাদের স্বামীর মঙ্গলকামনায় শাঁখা যত্ন সহকারে ব্যবহার করেন। কাটা বা ভাঙ্গা শাঁখা ব্যবহার করাকে তারা অমঙ্গল ও শঙ্কাজনক মনে করে। এ শাঁখা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতীক।

শ্রীলংকা থেকে আমদানি করা কাঁচামাল দিয়েই তৈরি হয় শাঁখা। তারপর তা সরবারহ করা হয় সারাদেশে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর আধুনিকতায় স্পর্শী বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই তৈরি হচ্ছে শাঁখা সিঁদুর। অভিজ্ঞ কারিগরদের হাতের নিপুণ স্পর্শে নানা ডিজাইনের শাঁখা তৈরি করে যাচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা। কোনোটা চিকন আবার কোনটা মোটা, আকাবাকা সব ডিজাইন করেই তৈরি হচ্ছে শাঁখা।

পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারের বিক্রেতা লিটন সাহা। বিশ বছর ধরে কাজ করছেন সাজঘর নামের একটা শাঁখা সিঁদুরের দোকানে। খুব ছোট থেকে এই পেশার সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজেকে। শাঁখা সিঁদুরের বর্তমান ব্যবসার অবস্থা জানতে চাইলে লিটন সাহা বাংলামেইলকে জানান, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে শাঁখা সিঁদুরের ব্যবসা। গত ১০ বছরে বিক্রি কমেছে প্রায় অর্ধেক। এর জন্য পণ্যের দাম বৃদ্ধিকে অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন লিটন সাহা। তিনি আরও জানান, গত কয়েক বছর আগেও যেখানে দিনে ১০ থেকে ১৫ জোড়া শাঁখা বিক্রি হতো, সেখানে এখন ২ থেকে ৩ জোড়া বিক্রি করতেই অপেক্ষা করতে হয় সারাটা দিন। কোনো কোনো দিনে এক জোড়াও বিক্রি হয় না।

লিটন সাহার কাছ থেকে জানা গেল, শীতের সময় ভিনদেশী পর্যটকের আনাগোনা এই পল্লীতে বেশ লক্ষ্য করার মতো। বিক্রিও হয় অনেক। তবে পূজার সময় বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যায়।

লিটন সাহার মতে বাংলা বছরের মাঘ-ফাল্গুন মাসে বেচা-কেনা চলে রমরমা। এই দুই মাস বিয়ের মাস হিসাবে দেখে সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়। সে হিসাবে শাঁখা সিঁদুরের বিক্রয়টাও হয় খুব ভালো।

এখানে শাঁখার দাম রুচি আর পণ্যের মানের উপর নির্ভর করে। তবে বাজারে প্রতি জোড়া শাঁখা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, সিঁদুর পাবেন প্রতি প্যাক ৮ থেকে ১০টাকা। ডিজাইনের দিক থেকে বর্তমানে চিকন শাঁখার কদর বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা। সৌখিন মনের অধিকারী কেউ কেউ শাঁখার ওপর স্বর্ণের কাজও করে নেন। কেউ আবার রঙিন পাথর বসান।

অমল বিশ্বাস নামের একজন ক্রেতা বলেন, দিন দিন জিনিসের দাম এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে মনে হয় ধর্ম মানাও কষ্ট হয়ে যাবে। মেয়েদের শাঁখা পরা বাদ দিতে হবে।

কালের আবর্তে ট্রেনে চেপে আজ প্রায় ক্লান্ত শাঁখা সিঁদুর শিল্প। বিক্রয় কর্মীরা সারাদিন দোকানে বসে থেকে অলসতার সঙ্গে দিন কাটায়। বিক্রি কমে যাওয়ায় কারিগরদের উৎপাদন কমিয়ে দিতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। তাই এখন শুধু অপেক্ষায় থাকা একটা বড় অর্ডারের। শাঁখারি বাজার শাঁখা ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকারের সদয় দৃষ্টি আর পরামর্শ এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। সমিতি থেকে আরও বলেন, শাঁখা শিল্পের বর্তমান অলসতার অবস্থা দেখে নতুন শ্রমিক এই শিল্পের সঙ্গে জড়াতে চাইছে না। তাই এভাবে চলতে থাকলে একদিন হারিয়ে যাবে বাঙালির শাঁখা সিঁদুরের ঐতিহ্য। আর যারা এই পেশার সঙ্গে আছেন শুধু মাত্র ইতিহাস আর ঐতিহ্য বুকে লালন করে টিকিয়ে রেখেছেন বাবা-দাদার বয়ে আনা ব্যবসা।



মন্তব্য চালু নেই