স্যান্ডেল বিক্রেতা সেজে খুনি ধরলেন এসআই বিল্লাল

পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি। পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল। কাঁধে পুরনো জুতাভর্তি ব্যাগ নিয়ে গ্রামের রাস্তায় হেঁটে চলেছেন এক ফেরিওয়ালা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাঁক ছাড়ছেন, ‘পুরান জুতা-স্যান্ডেল নিবেন গো, পুরান…’ না, এটা কোনো ফেরিওয়ালার গল্প না। এটি একটি ক্লুলেস হত্যা মামলার আসামি ধরার গল্প।

গেল বছরের ২৬ জুন যাত্রাবাড়ীর একটি মেস থেকে রিপন নামের মাঝবয়সী এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মরদেহটি বেশ কয়েক দিন আগের হওয়ায় তা পচে ফুলে ওঠে। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্নও নেই, যা দেখে পুলিশ সন্দেহ করবে এটি হত্যাকাণ্ড।

আবার যে বাসা থেকে মরদেহটি উদ্ধার হয়েছে, সেখানে অন্য কোনো মানুষও নেই। তালাবদ্ধ বাসা। তাই আর বিলম্ব না করে এটিকে অপমৃত্যু মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয় যাত্রাবাড়ী থানায়।

সপ্তাহখানেক পরে মৃতদেহটির ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। রিপোর্ট দেখে পুলিশের চোখ কপালে। সেখানে বলা হয়, ‘এটি কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। রিপনকে গলা টিপে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।’

এরপরই পুলিশের সন্দেহ তীব্র হলো। রিপনের বোনকে ডেকে পুরো বিষয়টি খুলে বলা হল। তিনি চলতি বছরের ৪ জুন যাত্রাবাড়ী থানায় রিপনের রুমমেটদের অজ্ঞাত আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার পান ওই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বিল্লাল আল আজাদ।

শুরু হলো রিপনের রুমমেটদের খোঁজা। কিন্তু তারা কেউ আর ওই এলাকায় নেই। আবার তাদের বিস্তারিত তথ্যও প্রতিবেশীদের কেউই জানেন না। তবে মুরসালিন নামে রিপনের এক রুমমেট পাশের গ্যারেজে বছরখানেক আগে কাজ করতেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে এসআই বিল্লাল ওই গ্যারেজে গেলেন।

গ্যারেজ মালিকের সাঙ্গে কথা বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পারলেন মুরসালিনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের হোসনাবাদ গ্রামে। বাবার নামের শেষ অংশ আলম। এই তথ্য নিয়ে এসআই বিলাল ছুটলেন বারিশালে। টানা দুইদিন জুতা বিক্রির ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরলেন ওই গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। কিন্তু আসামির বাবার নামের পুরো অংশ না থাকায় তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।

পরে ওই গ্রামের ভোটার লিস্ট সংগহ করেন এসআই বিলাল। সেখানে মোট সাতজনের নামের শেষে আলম পাওয়া যায়। জুতা বিক্রেতার ছদ্মবেশে তিনি একে একে সাতটি বাড়িতেই যান। এর মধ্যে সর্বশেষ বাড়ি অর্থাৎ সপ্তম আলমের বাসায় গিয়ে নিশ্চিত হন, এটাই মুরসালিনের বাড়ি। কিন্তু ওই বাড়িতে তালা! প্রতিবেশীরা জানালেন, মুরসালিন বাবাকে নিয়ে ঢাকায় কাজ করেন। এখানে আর তারা থাকেনও না, আসেনও না।

প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পারলেন, একবছর আগে থেকে মুরসালিন মোবাইল ব্যবহার বাদ দিয়েছেন। এখন শুধু তার বাবা মোবাইল ব্যবহার করেন। বাবার নম্বর ট্র্যাক করে পুলিশ জানতে পারে তিনি এখন মুন্সিগঞ্জের লৌহজং গ্রামে আছেন।

চলতি বছরের ২৬ জুন যাত্রাবাড়ীর থানার এসআই বিল্লাল চলে যান মুন্সিগঞ্জের লৌহজং গ্রামে। সেখান থেকে মুরসালিন সন্দেহে এক যুবককে আটক করেন। কিন্তু তার বাবার নামের শেষে কোনো আলম নেই। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক জানান, অন্য এক মুরসালিন ওই গ্রামেরই পূর্ব পাড়ায় এক বাড়িতে কাজ করেন।

রাত তখন সাড়ে ৩টা। মুন্সিগঞ্জ থানার ফোর্স নিয়ে এসআই বিল্লাল রওনা হলেন পূর্বপাড়ার সেই বাড়িতে, যেখানে মুরসালিন কাজ করে। বাড়িটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের। চারদিকে শক্ত প্রাচীর। গেটে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম লাগানো। বাড়ির মালিকের দুটো লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে বলেও স্থানীয় সূত্রে পুলিশ জানতে পারে। এমতাবস্থায় ওই বাড়ির কলিং বেল টিপে ভেতরে ঢুকতে গেলে আসামি পালিয়ে যাবে। তাই আর বিলম্ব না করে প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢোকে পুলিশ। এ সময় দেখা যায়, মুরসালিন ওই বাড়ির ভেতরের একটি কক্ষে প্লাস্টারের কাজ করছেন। কাজটি জরুরি, তাই রাত ধরেই সে কাজ করছে।

মুরসালিনকে গ্রেপ্তার করে আনা হয় যাত্রাবাড়ী থানায়। পরে আদালতের নির্দেশে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সে জানায়, রিপনের সাথেই রুম শেয়ার করে থাকতো। কিন্তু রিপনের এক বন্ধু আসায় রিপন মুরসালিনকে নতুন বাসায় উঠতে বলে। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে রিপন মুরসালিনকে মারধর করে। মুরসালিনও রিপনকে পাল্টা আঘাত করে। একপর্যায়ে রিপনকে গলা টিপে মারে মুরসালিন। পরে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় এই হত্যাকারী।

এসআই বিল্লাল আল আজাদ বলেন, ‘তদন্ত করার জন্য এটিই আমার সবচেয়ে বড় মামলা। সে কারণে আমি সর্বোচ্চটা দিয়েছি আসামিকে অ্যারেস্ট করার জন্য। যদিও সেটা খুব কঠিন ছিল। এ হত্যার ঘটনায় কোনো ক্ল বা স্বাক্ষী, কিছুই ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘আমার শিক্ষানবিশ কালের অভিজ্ঞতা, সিনিয়রদের কাছ থেকে দক্ষতাকে সমন্বয় করে এ মামলায় কাজ করেছি। কাজ করার সময় অনেক বাধা প্রতিকূলতার সম্মুখিন হয়েছি, কিন্তু পিছিয়ে যাইনি। শুধু একটাই মনের মধ্যে লালন করেছি, আমাকে পারতেই হবে। খুনিকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর সে কারণেই এতো অল্প সময়ে মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছি। মামলাটি তদন্তে ওসি স্যারসহ সিনিয়ররা খুবই সহযোগিতা করেছেন, আমার মতো নতুন অফিসারকে সাহস যুগিয়েছেন।’

এ পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আসামি ধরার পর নিহত রিপনের মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। আমার বুকে হাত বুলিয়ে তিনি বলেন- “তুমি আমার সন্তান। এক সন্তান মরে গেছে তো কি হয়েছে, আরেক সন্তানকে তো পাইছি।” তার অনুভূতিই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার, সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।’

যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান মামলাটি প্রসঙ্গে বলেন, ‘রিপন হত্যা মামলাটি একটি ক্লুলেস মামলা। তারপরও তদন্ত কর্মকর্তা তার বুদ্ধিদীপ্ত তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে।’ খবর বাংলামেইলের।



মন্তব্য চালু নেই