স্বাধীনতার সূর্য | আকিদুল ইসলাম সাদী

বহু ত্যাগ ও কোরবানীর বিনিময়ে দীর্ঘ ১৯০ বছর পর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটলো। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫-ই আগস্ট জন্ম হলো ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের। অঙ্গ রাজ্যগুলো গণভোট ও সংখ্যাগরিষ্টতা হিসেবে দুই দেশের যে কোন একটির অন্তর্ভুক্ত হলো। সেই হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান। দুই পাকিস্তানের মধ্যে দুরত্ব ছিলো ২,০০০ কি.মি.। উভয় অংশের জনগণের মধ্যে ধর্ম ব্যতিরে আর কোন মিল ছিলো না। পাকিস্তানের রাজধানী করা হয় করাচিতে। পরে স্থানান্তরিত করা হয় ইসলামাবাদে। উভয় অংশের শাসনভার ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে হাতে। ফলে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতো সবচেয়ে বেশি। অবহেলা করতো পূর্ব পাকিস্তানকে। চাকরি-বাকরি সকল ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঞ্চিত হতো। শুধু তাই-ই নয়; ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা বাংলাকে কেড়ে নেওয়ারও ষড়যন্ত্র করা হয়। ঘোষণা করা হয়,“উভয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দূ”। কিন্তু বাংলা ভাষীরা তা মেনে নেয়নি। ফলে শুরু হয় আন্দোলন। প্রাণ হারায় শফিক, রফিক, বরকত, সালাম জব্বারসহ অনেকে। কারাবরণও করেন বাংলা মায়ের অনেক সন্তান। এই আন্দোলনে শরিক ছিলেন বিভিন্ন পেশার লোক। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সূর্য সন্তান ওলামায়ে কেরামও। তাদের মধ্য থেকে মাওলানা মুহিউদ্দিন খান রহ.-এর কথা বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তিনি এই আন্দোলনের কারণে দীর্ঘ দেড় মাস কারাবরণ করেন। এরপর থেকে বাঙালী জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষে এক একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে।

১৯৫৮ সালে আউব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন শুরু করেন। পরে ১৯৬২ সালে তিনি মৌলিক গনতন্ত্র প্রবর্তন করের্ন। এ ব্যবস্থায় জনগণের প্রতক্ষ্য ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনের অধিকার হরণ হয়। ফলে এ দেশের মানুষ তাদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকারের প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে।

পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। তাঁর সাথে ওলমায়ে কেরামও তখন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যার মধ্যে মাওলানা শেখ উবাইদুল্লাহ বিন সাঈদ ও মাওলানা অলিউর রহমানের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। ছয় দফা দাবির মূলকথা ছিলো পাকিস্তানের শাসকগোষ্টির শাসন-শোষণ থেকে বাঙালী জাতির মুক্তি। এ দাবি আদায়ের লক্ষে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। আউব খান আন্দোলনকারীদেরকে দমন করার লক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ শীর্ষ বঙালী নেতাদেরকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করেন। ১৯৬৮ সালে তাদের নামে “আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ সালে মামলার শুনানিতে সকল কারাবন্ধিরা সবাই মুক্তি পান। তাছাড়া তখন পশ্চিম পাকিস্তানেও আউব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ফলে তিনি একই সালের ২৫ শে মার্চ সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়াহইয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। অতপর তিনি এসে নির্বাচন দেন।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামিলীগ জয় লাভ করে। সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে আওয়ামিলীগকে কেন্দ্রিয় মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক শাসকগোষ্টি তা করতে দেয়নি। ১৯৭১ সালের ৩-ই মার্চে শুরু হওয়ার কথা ছিলো জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন।কিন্তু তাও হয়নি। ঠিক তার দু‘দিন আগে হঠাৎ করে ইয়াহইয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। ফলে এ দেশের মানুষের মাঝে প্রচ- ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

অতপর বঙ্গবন্ধু ৭-ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়র্দী ময়দান) বিশাল সমাবেশ করেন। সমাবেশ শুরু করা হয় কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে। কোরআন তেলওয়াত করেন মাওলানা শেখ উবাইদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। তারপর শুরু হয় ভাষণ। বঙ্গবন্ধু হুংকার ছেড়ে বলেন, “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি প্রয়োজনে আরো দিবো, তবু এবার বাংলাদেশকে করেই ছাড়বো ইন-শা-আল্লাহ”। তাঁর এই ভাষণে গর্জে ওঠে বাঙালী জাতি। শুরু হয়ে যায় অসহযোগ আন্দোলন। পুরো দেশ থেকে অচল হয়ে পড়ে পাকিস্তানী শাসন। কোন উপায় না দেখে আউব খান আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন।

আলোচনা চলে দীর্ঘ ১০ দিন ধরে, কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হয় না। পরবর্তীতে ইয়াহইয়া খান ও তার সহযোগী জুলফিকার আলি ভূট্টো রাজনৈতিক কোন সমাধান না দিয়ে ২৫ শে মার্চে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেদিন বাংলার আকাশে নেমে আসে এক কালো অধ্যয়। রাতে শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম গণহত্যা। ইতিহাসের পাতায় যা কালো রাত হিসেবে লেখা। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করার অপরাধে প্রাণ হারান মাওলানা অলিউর রহমান রহ.। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। দিশেহারা হয়ে যায় দেশবাসী। কী করবে , কী হবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না কেউ। এমন নাজুক সময়ে ২৭ শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা শুনে অসহায় বাংলার জনগণ অনুপ্রাণিত হয়। খুজে পায় একজন আস্থার প্রতিক। সকলে ঝাপিয়ে পড়ে ময়দানে। যুদ্ধ চালায় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে।

অতপর ৪-ই এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোতে প্রথম সেনা বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মেইন উদ্যোক্তা ছিলেন মাওলানা আছাদ আলি। পরবর্তীতে ১৭-ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে (বর্তমান মুজিবনগর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি; সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি; তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধান মন্ত্রি করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অতপর দেশের সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে গঠন করা হয় মুক্তিবাহিনী। তাদের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত হোন কর্নেল আতাউল গনী উসমানী। যুদ্ধ পরিকল্পনা হিসেবে দেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এক এক সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীকে। দেশকে মুক্ত করতে ও নিজ অধিকার আদায়ে মরণপণ যুদ্ধ চালায় মুক্তিবাহিনী। তারা অস্ত্রে-শস্ত্রে দূর্বল হলেও গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে নাজেহাল করে ফেলে।

ভারত সরকার এবং জনগণও এগিয়ে আসে আমাদের সাহায্যে। ফলে এক পর্যায় ভারতীয় বাহিনী ও আমাদের মুক্তিবাহিনী মিলে গঠন করা হয় যৌথ কমান্ড। পরবর্তীতে এই যৌথবাহিনীর কাছেই ১৬-ই ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। প্রায় দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলার বুকে উদিত হলো “স্বাধীনতার সূর্য”। বিশ্ব মানচিত্রে যুক্ত হলো বাংলাদেশ নামে আরেকটি দেশ। পরাধীনতার শিকল ছেদ করে আমরা পেলাম স্বাধীনতা। মুক্ত হলো বাংলাদেশ।



মন্তব্য চালু নেই