আজ বগুড়ার শেরপুরে ঐতিহাতিক গণহত্যা দিবস

স্বাধীনতার পর আজও শহীদ মোখলেছুরের স্ত্রী’র ভাগ্যে জোটেনি সরকারী ভাতা

আজ বগুড়ার শেরপুরের ঐতিহাসিক গণহত্যা দিবস। মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগের ঘটনা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বগুড়ার শেরপুরে শহীদদের গণকবরগুলোর মধ্যে দড়িমুকুন্দ এর নিরাপত্তার প্রাচীর ও নামফলক স্থাপন করা হলেও কল্যাণী, ঘোগা, গোপালপুর, বাগড়া কলোনির গণকবর এখনো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে।এমনকি অস্তিত্ব বিলীনের পথে। তবুও গনকবরগুলো সংরক্ষণের দাবী নিয়ে শহীদ পরিবারগুলো স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি এ গণহত্যা দিবসটি অশ্রুসজল চোখে,শোকার্ত হৃদয়ে পালন করে আসছে।

এদিকে দড়িমুকন্দ গণকবরে দীর্ঘদিন ধরে আত্মবিলাপ করে আসলেও গণকবরে নামফলকে উল্লেখিত শহীদ মোখলেছুর রহমানের স্ত্রী খোদেজা বেগমের ভাগ্যে আজও সরকারী ভাতা না জোটায় এবং পুর্নবাসন না পেয়ে অন্যের বাড়িতে মাথা ঠাই নিয়ে ঝিঁয়ের কাজ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মুক্তিযুদ্ধে বগুড়ার শেরপুরের উপজেলার দড়িমুকুন্দ গ্রামের শহীদ মোখলেছুর রহমানের স্ত্রী খোদেজা বেগম জানায়, একাত্তরে দড়িমুকন্দ গ্রামে স্ব-চক্ষে দেখা গণহত্যার লোমহর্ষক ও বেদনাবিধুর ,ভয়াল রাতের কাহিনী । তার দেয়া তথ্যে জানা যায়, তার স্বামী শহীদ মোখলেছুর রহমান যুদ্ধকালীন সময়ে ৬ মাসের শিশু সন্তান পাপিয়াকে ১৫/২০ দিন পরপর দেখতে আসতো। একদিন বাড়িতে আসলে ঘোলাগাড়ি গ্রামের রাজাকার ময়েজ উদ্দিন ও হাবিল বিহারী দেখতে পেয়ে মিলিটারীদের খবর দিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসে। মিলিটারীরা তার স্বামীর হাত-পা বেঁধে বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে আমাদের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় ।

এসময় আমার স্বামী চিৎকার দিয়ে বলেন“ পাপিয়াকে নিয়ে পালাও খোদেজা,আমার জীবন শ্যাষ” বলতে গুলির শব্দে আমার কান স্তব্ধ হয়ে আসে এবং আমি ঘর থেকে বাহিরের এক ঝোপের কাছে শিশু কন্যাকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় বুক ভাসাই। স্বামীকে হত্যা করে মিলিটারীরা বাংলাদেশের পাখি মারছে বলে উল্লাস করতে করতে চলে যায়।

এসব কথাগুলো কান্নাজড়িত কন্ঠে শহীদ স্বামীর খচিত নাম ফলকে হাত ও গণকবরে আত্মবিলাপ করতে থাকেন। এসময় তিনি অভিযোগ করে বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে তার স্বামী শহীদ হলেও স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও

মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের স্বীকৃতি, ভাগ্যে জোটেনি সরকারী ভাতা। মুক্তিযুদ্ধের তালিকাভুক্ত করতে শহীদ মোখলেছুর রহমানের নাম লিপিবদ্ধ করণের জন্য উপজেলার সরকারী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধানেতাদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ধর্ণা দিয়ে আসলেও পাত্তা পাচ্ছেনা। তাছাড়া ২০ হাজার টাকায় মিলবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার শহীদ স্বামীর নাম এমনি অভিযোগ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধানেতা ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি অভিযোগ করেন খোদেজা। টাকা যোগাড় ও অন্ন-বস্ত্রের অভাবে ভিটামাটি হারিয়ে অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে থেকে দিনাতিপাত করছেন বলে গত ২৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বিকালে সরেজমিনে দড়িমুকন্দ গণকবরে গেলে দুঃখজড়িত কন্ঠে,বিলাপের সাথে বলেন এ প্রতিবেদকের কাছে শহীদ মোখলেছুর রহমানের স্ত্রী খোদেজা বেগম।

উপজেলার বাগড়া কলোনি গ্রামের ফরিদ উদ্দিন জানান, মুক্তিযুদ্ধে বগুড়ার শেরপুরের দড়িমুকুন্দে গণহত্যার যে ঘটনা ঘটেছে তার বর্ণনা শুনে এখনো অনেকের গা শিউরে উঠে।, তার বাবা সদর আলী সরকারসহ গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক লোক স্বাধীনতার পক্ষে মিছিল নিয়ে গ্রামের পাশের প্রধান সড়কে যান।

এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিছিলকারীদের ঘেরাও করে এবং ধরে নিয়ে যায় গ্রামের তৎকালীন মনছের আলীর ইটের ভাটায়। সেখানে ইট ভাটার ভেতর লাইন করে বসিয়ে রেখে তাঁদের উপর চালানো হয় মেশিনগানের গুলি। বর্বরোচিত কায়দায় স্বাধীনতাকামী মানুষগুলোকে হত্যা। এ স্থানটি বর্তমানে কয়েকটি তালগাছ দিয়ে ঘেরা রয়েছে।

সুত্রমতে প্রকাশ: ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের দড়িমুকুন্দ গ্রামে পাকিস্তানী সেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া হাবিবুর রহমান জানান, দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল। মাত্র ৭জন পাকিস্তানী মিলিটারী তাদের দড়িমুকুন্দ গ্রামে হানা দেয়। তারা গ্রামের লোকদের ডেকে নিয়ে গ্রামের প্রবেশ পথের দু’ধারে লাইনে দাঁড় করিয়ে ২৪ জন স্বাধীনতাকামী আজাহার আলী ফকির, ওসমান গণি ফকির, আজিজুর রহমান, একরামুল হক, সুজার উদ্দিন, সেকেন্দার আলী, বুল মাজন মিয়া, রমজান আলী, মোখলেছুর রহমান, ইসাহাক আলী, আবেদ আলী, আলিমুদ্দিন, ছোবহান আলী, গুইয়া প্রামানিক, দলিল উদ্দিন, হাসেন আলী, উজির উদ্দিন, আয়েন উদ্দিন, আফজাল হোসেন, মোহাম্মাদ আলী, আজিমুদ্দিন, নেওয়াজ উদ্দিন, হায়দার আলী ও জপি প্রামানিককে গুলিবর্ষন হত্যা করে। পরে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের প্রতিটি বাড়ি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে মিলিটারীরা চলে যায়।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ওবায়দুর রহমান জানান, পাকসেনারা ঘোগাব্রিজ এলাকায় ৩০০জন ও গোপালপুর এলাকায় ১৮-২০জন, বাগড়া কলোনী বধ্যভুমিতে ৩২জন, ওই গ্রামের পূর্বপাশের এক ভিটায় ১০/১২জনকে কবর দেয়া হলেও উপজেলার (খাগা হিন্দুপাড়া), গোপালপুর গ্রামেও নারকীয় হত্যাযজ্ঞে স্বাধীনতাকামীদের হত্যা করা হলেও গণকবর

সংরক্ষণের অভাবে স্বাধীনতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ স্থানগুলো বর্তমানে চেনা কষ্টসাধ্য। স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও শহীদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণে প্রশাসন কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে গণকরর ও বধ্যভুমিগুলো এদিন নিশ্চিন্ন হয়ে যাবে। আর কতদিন এভাবেই নিরবে নিভৃতে সংরক্ষণ ও সংস্কার বিহীন বধ্যভুমির দাবিদার শহীদপরিবারদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম সরোয়ার জাহান বলেন, আমি এখানে এসে স্বাধীনতাযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত শহীদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকারি সহযোগীতা নিয়ে সাধ্যমত সংস্কার করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া শহীদ মোখলেছুর রহমানের স্ত্রী আমার কাছে কোন সহায়তার জন্য আসে নাই। তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।



মন্তব্য চালু নেই