সোয়াইন ফ্লু : ঝুঁকি ও করণীয়

আমাদের পাশের দেশ ভারতে নতুন করে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে ‘সোয়াইন ফ্লু’। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর গত শনিবার (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে সাত শ’র বেশী মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ সময়ের মধ্যে ১২ হাজারের বেশী মানুষ ‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছরই কম-বেশী লোক ‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত দেশে ‘সোয়াইন ফ্লু’র ব্যাপক বিস্তারের খবর পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি এ বছর এখন পর্যন্ত সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্তের কোনো খবর বাংলাদেশের কোনো হাসপাতাল থেকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ বর্তমানে ‘সোয়াইন ফ্লু’র ঝুঁকির আওতায় বসবাস করছেন। তাই এখনই আমাদের ‘সোয়াইন ফ্লু’ প্রতিরোধে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।

সরকারিভাবেও সমস্যাটির ব্যাপকতা অনুভূত হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ‘সোয়াইন ফ্লু’ প্রতিরোধ করতে হলে ব্যাপক জনসংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন। জনগণকে এ রোগের ব্যাপারে সঠিক তথ্য ও বাংলাদেশের এর বিস্তার কতটুকু এবং আমরা কতটুকু ঝুঁকিতে বসবাস করছি তা বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে।

‘সোয়াইন ফ্লু’ মূলত শুকরের ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর। এ নাম শুনেই আমরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি। কিন্তু এবার মানবজাতি আক্রান্ত ও আতঙ্কিত হয়েছে ‘সোয়াইন ফ্লু’র কারণে। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ও এদের মধ্যে থেকে মৃত্যুর হার দ্রুত বেড়ে চলেছে।

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সারাবিশ্বে ‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্তদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০০৯ সালে মেক্সিকোতে প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর এদগার হার্নান্দেজ নামের ৫ বছর বয়সী শিশু এ ভাইরাতে প্রথম আক্রান্ত হয়। পরবর্তী সময়ে হার্নান্দেজ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও মেক্সিকোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভে করে ‘সোয়াইন ফ্লু’। শুধু মেক্সিকোতেই ২ হাজারের বেশী মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ৪ মে পর্যন্ত ১৬৮ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। মেক্সিকোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রেও প্রায় প্রতি বছরই সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। গত বছরের শেষ দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশসমূহে সোয়াইন ফ্লুর বিস্তৃতি দেখা যাচ্ছে। এ রোগ ইতোমধ্যে ল্যাটিন আমেরিকা, উত্তর ইউরোপ ছাড়িয়ে হংকং, চীন পর্যন্ত ছড়িয়েছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ‘সোয়াইন ফ্লু’র বিস্তৃতি নিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ ও মেক্সিকোর এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার বিশেষজ্ঞগণ বৈঠক করেছেন এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আক্রান্ত দেশগুলো ও সম্ভব্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের জন্য করণীয় বলে দিয়েছে।

‘সোয়াইন ফ্লু’ অন্যান্য ভাইরাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের মতোই একটি রোগ, যা শুকরের শরীরেও হয়। এ রোগে শুকর সারা বছরই কম-বেশী আক্রান্ত হলেও শরতের শেষ ও শীতের শুরুতে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। ‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্ত হয়ে শুকরের মৃত্যুর ঘটনা কমই ঘটে। এটি মানুষের ফ্লুর মতোই, একই সময়ে হয় এবং নিজে নিজেই সেরে যায়। আর এটিও শুকরের শ্বাসতন্ত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণত।

‘সোয়াইন ফ্লু’ একটি প্রচণ্ড ছোঁয়াচে রোগ। ১৯৩০ সালে পৃথিবীব্যাপী এ ফ্লুর ব্যাপক মহামারী ঘটেছিল। ‘সোয়াইন ফ্লু’র ভাইরাসটির চারটি ধরন আছে— H1N1, H1N2, H1N3, H1N4। এর মধ্যে H1N2 ভাইরাসটি সচরাচর ‘সোয়াইন ফ্লু’ ঘটায়।

‘সোয়াইন ফ্লু’ ভাইরাসটি সাধারণত মানুষকে আক্রান্ত করে না। তবে যারা শুকরের খুব কাছাকাছি থাকেন, তারা কোনো কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন এ ভাইরাসে। যে সব শিশু শুকরের আবাসস্থলের খুব কাছাকাছি থাকে এবং শুকরের কারখানায় কর্মরত মানুষরা ঝুঁকিতে থাকেন। ১৯৯৮ সালে বেশ কিছু মানুষ ‘সোয়াইন ফ্ল’তে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০০৫-২০০৯ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি যুক্তরাষ্ট্রে মোট ১২ জন রোগীর সন্ধান পেয়েছে।

‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্ত হলে মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই উপসর্গ দেখা দিবে। এর মধ্যে আছে— মৌসুমী জ্বর, দুর্বলতা, অরুচি ও কাশি। কারো কারো নাক দিয়ে পানি পড়তে ও গলা ব্যথা হতে পারে। বমি বমি ভাব ও পাতলা পায়খানাও হতে পারে কারো কারো।

‘সোয়াইন ফ্লু’র ভাইরাসটি আক্রান্ত মানুষ থেকে আশপাশের মানুষের দেহে পৌঁছায় শুধুমাত্র হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। ঠিকমতো রান্না করা শুকরের মাংস খেলে এ রোগ হয় না। যদি শুকরের মাংস ১৬০◦ ফারেনহাইটে সিদ্ধ করা হয় তবে অন্যান্য ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার মতো সোয়াইন ফ্লু’র ভাইরাসও মারা যাবে। একইভাবে আক্রান্ত মানুষ থেকে শুকর ও শুকর থেকে মানুষও আক্রান্ত হয়।

‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারে মৃত্যুবরণ করার ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ভাইরাসটি নতুন কারো দেহে প্রবেশ করার পর পরই এর নিজের জেনিটিক গঠন পরির্বতন করে ফেলে। সোয়াইন ফ্লু মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জার শঙ্কর তৈরি হতে পারে।

আবার ‘সোয়াইন ফ্লু’ ‘বার্ড ফ্লু’র শঙ্করও তৈরি হতে পারে। তেমনি পারে মানুষের ইনফ্লুয়েঞ্জা ও বার্ড ফ্লু’র শঙ্কর ভাইরাস। এর ফলে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া দুস্কর। আর বিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম হয়েও এর টিকা বানাতে পারছে না। ‘সোয়াইন ফ্লু’তে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসনালী হতে আক্রান্ত হবার ৪-৫ দিনের মধ্যে রস নিয়ে পরীক্ষা করে এ ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়। কিন্তু এর জন্য উচ্চমাত্রার যান্ত্রিক সুবিধা দরকার। ‘সোয়াইন ফ্লু’ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করার মতো চারটি ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর বাজারে পাওয়া গেলেও এগুলোর কার্যকারিতা আশাব্যঞ্জক নয়।

পৃথিবীর মানুষের চলাচল বৃদ্ধি পাবার কারণে এ ভাইরাসের বিস্তারও সহজ হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এ ‘সোয়াইন ফ্লু’ পরিস্থিতিকে তাদের ৫ মাত্রার বিপদ বলেছে। এর অর্থ হল ‘সোয়াইন ফ্লু’র ব্যাপকতা পৃথিবীব্যাপী মহামারির ঠিক পূর্বাবস্থায় আছে। যেকোনো সময় এটি ৬ মাত্রায় অর্থাৎ মহামারী অবস্থায় পৌঁছাতে পারে। এ জন্য সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত দেশের মানুষদের সচেতন হওয়া জরুরী। এর সাথে পরবর্তী দেশসহ যে সকল দেশের সাথে এ সব দেশের ঘন ঘন যোগাযোগ হচ্ছে তাদের ও সতর্ক হতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে নজর রাখছেন বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ রোগে কারো আক্রান্ত হবার তথ্য পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও এতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে আছেন।

কীভাবে এ রোগ ছড়ায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য

  • হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ রোগ ছাড়াতে পারে।
  • রোগীর সর্দি-কাশি লেগে থাকা কোনো জিনিস স্পর্শ করলে।

‘সোয়াইন ফ্ল’তে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পাবার জন্য করনীয়

  • হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে নিন।
  • হাঁচি-কাশি গেয়ার সময় পরিষ্কার রুমাল-গামছা-কাপড় বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করুন।
  • ব্যবহৃত রুমাল-গামছা-কাপড় ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
  • ব্যবহৃত টিস্যু পেপার যেখানে সেখানে না ফেলে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন।
  • হাঁচি-কাশি দেবার সময় খালি হাতে কখনই নাক-মুখ ঢাকবেন না। রুমাল-গামছা-কাপড় বা টিস্যু পেপার না থাকলে জামার হাতা-শাড়ির আচঁল দিয়ে নাক-মুখ ঢাকুন এবং ঘরে ফিরে ওই জামা-শাড়ি সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
  • নিয়মিতভাবে সাবান-পানি দিয়ে দুই হাত ভাল করে ধুয়ে নিন।
  • জ্বর-সর্দি-কাশি হলে অন্যেও সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন এবং যতটা সম্ভব বাড়িতে থাকুন।

ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যাপারটির গভীরতা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছে এবং দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তারপরও রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে করণীয় জরুরী পদক্ষেপ সমূহ

ক) সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে বসবাসরত ছেলে-মেয়েদের রক্ষা করার জন্য স্কুলসমূহ আপাতত বন্ধ রাখা দরকার।

খ) যতদ্রুত সম্ভব সকলের হাতের নাগালে ‘সোয়াইন ফ্লু’র বিস্তার রোধকারী মুখোশ (SURGICAL GLOVES) পৌঁছাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

গ) সংশ্লিষ্ট সকল স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঘ) প্রতিদিন বিশেষ গুরুত্বের সাথে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ‘সোয়াইন ফ্লু’ সম্পর্কে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করার ব্যবস্থা করতে হবে।

ডা. শাহজাদা সেলিম
এমবিবিএস, এমডি (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম)
এমএসিই (ইউএসএ)
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা



মন্তব্য চালু নেই