নারীদের লাঞ্ছিত করার ছবি সিসি ক্যামেরায় ॥ পরিকল্পিতভাবে ঘটেছে ঘটনা

সেদিন রক্ষা পায়নি বয়স্ক নারী ও শিশুরাও

একদল তরুণ বারবার মেয়েদের ঘিরে ধরছে। ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করছে তারা। পয়লা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকের সামনের রাস্তার দৃশ্য এটি। পুলিশের বসানো ৫ নম্বর সিসি ক্যামেরায় সন্ধ্যা ছয়টা ২২ মিনিট থেকে সাতটা ২২ মিনিট পর্যন্ত ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে এ রকম অন্তত ১০টি দৃশ্য ধরা পড়েছে।

ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অন্তত চারজনকে শনাক্ত করা গেছে, যারা ওই জায়গার মধ্যেই ঘুরছে-ফিরছে, ঠেলাঠেলি করে জটলা তৈরি করছে, মেয়েদের ঘিরে ধরছে। এই চার তরুণের প্রত্যেকের মুখে একই ধরনের চাপদাড়ি রয়েছে। এদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি বয়স্ক নারী ও শিশুরাও।

ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ফুটেজ দেখে বলেন, তাঁর মনে হয়েছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে।
ফুটেজে দেখা যায়, ওই তরুণেরা মেয়েদের ঘিরে ধরছিল। ভিড়ের কারণে যে এ রকমটা হয়নি, তা ফুটেজে স্পষ্ট। বৃত্তের মাঝে কী হচ্ছিল, তা ফুটেজে বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু বের হয়ে ওই নারীদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা নিগৃহীত হয়েছেন।

ওই সব ফুটেজে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি লিটন নন্দীকে ওই তরুণদের সঙ্গে মারামারি করতে দেখা যায়। সন্ধ্যা সাতটার পরে দৃশ্যপটে পুলিশ আসে। লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর পরই ওই এলাকায় ভিড় হালকা হয়ে আসে। যানবাহনও চলাচল শুরু করে। লাঠিপেটার পর ওই তরুণদের একজনকে ঘটনাস্থলে ঘুরতে দেখা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুপুরের পর থেকেই টিএসসি হয়ে যান চলাচল শুরু করে। ভিড়ের মধ্যে রিকশা, গাড়ি, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা বাড়তি চাপ তৈরি করে। ফুটেজেও এসব যানবাহন চলতে দেখা গেছে।

ফুটেজ বিশ্লেষণ: সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিট থেকে ৬টা ৩৩ মিনিট পর্যন্ত এ রকম ভিড়ের মধ্যে ওই তরুণদের অন্তত তিনজন নারীকে ঘিরে ধরে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা যায়। ৬টা ৩৮ মিনিটে ধাক্কাধাক্কির মাত্রা বেড়ে যায়। পথচলতি পাঁচটি মোটরসাইকেল আরোহীও ভিড়ের তলে পড়েন।

৬টা ৪৩ মিনিটের দিকে একাকী একটি মেয়েকে রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে দেখা যায়। কিন্তু তাঁকে চারদিক থেকে কয়েকজন ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে তরুণদের সঙ্গে হাত নাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন। দেখে মনে হয়েছে তিনি এর প্রতিবাদ করছিলেন।
সন্ধ্যা ৬টা ৫১ মিনিটে ওই তরুণদের পর পর দুটি মেয়েকে ঘিরে ধরতে দেখা যায়। এ সময় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দীসহ কয়েকজনকে হামলাকারীদের সঙ্গে মারামারি করতে দেখা যায়। সেখানেও কয়েকজন তরুণ ছিল। পরে কয়েকজন দুই তরুণীর একজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।

জানতে চাইলে লিটন নন্দী বলেন, তিনি ওই ফুটেজটি দেখেছেন। ওই ক্যামেরার আওতার বাইরে দক্ষিণ পাশে কিছুক্ষণ আগে আরও একটি ঘটনা ঘটে। সেখানে এক তরুণীকে প্রায় বিবস্ত্র করা হয়। ওই তরুণীকে লিটন তাঁর পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে রিকশায় করে তরুণীর সঙ্গীসহ রোকেয়া হল পর্যন্ত এগিয়ে দেন। পরে পাঞ্জাবি ফিরিয়ে নেন। তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই বলছি, একটা সংঘবদ্ধ চক্র পরিকল্পিতভাবে এ কাজ করছে।’ ওই তরুণদের বিষয়ে জানতে চাইলে লিটন বলেন, অনেকের সঙ্গে সেখানে তাদেরও দেখেছেন তিনি।

সন্ধ্যা ৬টা ৫৬ মিনিট থেকে ৬টা ৫৮ মিনিট পর্যন্ত এ রকম আরও কয়েকটি প্রচণ্ড ঠেলাঠেলির দৃশ্য দেখা যায়। ওই তরুণদের একটি মোটরসাইকেল আটকাতে দেখা যায়। যেখানে চালকের পেছনে একজন নারী আরোহীও ছিলেন।

সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে দেখা যায়, শাড়ি পরা দুজন নারী ভিড়ের মধ্যে হাঁটছেন। একজন চশমা পরিহিত মধ্য বয়স, আরেকজন কম বয়স্ক। হঠাৎ সাত-আটজনের একটি দল তাঁদের ঘিরে ধরল। দুই নারীর মাথা যেন তরুণদের বৃত্তের মধ্যে ডুবে গেল। কিছু সময় পরে দেখা গেল, কম বয়সের মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আছেন বয়স্ক নারীটি। পোশাক ঠিক করে দিচ্ছেন।

সন্ধ্যা ৭টা ৭ মিনিটে দেখা গেল, হামলাকারীরা চারটি মেয়েকে একসঙ্গে ঘিরে ধরে। যাদের দুজন একেবারেই শিশু। ফুটেজে দেখা যায়, ওই নারীদের তরুণেরা ঘিরে ধরে প্রায় পিষে ফেলার উপক্রম করেছিল। ওই সময়ই একদল পুলিশ এসে লাঠিপেটা করে ওই নারীদের উদ্ধার করে। একজনকে পুলিশের কয়েকজন মিলে ঘিরে ধরে বেদম পিটুনি দেয়। দুই যুবক ওই চার নারীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

পুলিশ যা বলে: এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ করে তরুণদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলছেন।

আর সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের কোনো অবহেলা ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতেও একটি কমিটি করা হয়েছে।
তবে বাংলা নববর্ষের দুই দিন আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে নববর্ষের নিরাপত্তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছিলেন, ‘পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে, যা ডিএমপির সদর দপ্তর থেকে মনিটরিং করা হবে।

এ ছাড়া রমনা পার্কে একটি আলাদা মনিটরিং সেল থাকবে। ইউনিফর্ম ও সিভিল পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কয়েক স্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। অনুষ্ঠান চলাকালে নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো প্রকার ব্যাগ, সন্দেহজনক বস্তু, অস্ত্র, ছুরি ইত্যাদি নিয়ে কেউ অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতে পারবে না।’

তবে দিন শেষে কয়েকজন তরুণী আজীবনের দুঃস্বপ্ন নিয়ে ফেরত গেছেন। ঘটনাস্থলে প্রতিবাদকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মী ও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বললে তাঁরা বলছেন, ‘নিরাপত্তার আয়োজন সব লোক দেখানো।’ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা লিটন নন্দী বলেন, ‘ঘটনার শুরুতে সেখানে দুজন পুলিশ ছিল। আমরা তাদের বলেছি, আপনারা নিয়ন্ত্রণকক্ষ বা থানায় খবর দেন এখানে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। কিন্তু এর পরবর্তী এক ঘণ্টাতেও সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ আসেনি। পরে আমরা নিজেরাই কর্মীদের ডেকে তাদের ধাওয়া করে তাড়ানোর চেষ্টা করি। এরও অনেক পরে পুলিশ এসে সেখানে লাঠিপেটা করে সবাইকে সরিয়ে দেয়।’

আরো পড়ুন :

সে দিন কি ঘটেছিল টিএসসিতে ? সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ, ভিডিওসহ দেখুন


পহেলা বৈশাখে নারীকে বিবস্ত্র করে টিএসসিকে কলঙ্কিত করল ওরা


“এ দৃশ্য বর্ণনা করা যায় না ॥ আমার পাঞ্জাবি খুলে এক বিবস্ত্র নারীকে দিয়েছিলাম”



মন্তব্য চালু নেই