সেই ফারাক্কা এখন ভারতের গলার কাঁটা

নানা সুবিধার আশায় প্রায় চার দশক আগে বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদী গঙ্গার উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল ভারত। যদিও তখন কয়েক সপ্তাহের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা বলে বাংলাদেশের অনাপত্তি নিয়েছিল ভারত, কিন্তু সেই পরীক্ষা আজ ৪০ বছরেও শেষ হয়নি। এই সময়ে বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য বিপুল ক্ষতির কারণ হয়েছে ফারাক্কা। আর কালের পরিক্রমায় সেই বাঁধ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের। দেশটির বিহারসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে এই বাঁধকে।

সম্প্রতি ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন, বিহারে গঙ্গা অববাহিকায় বন্যার জন্য দায়ী ফরাক্কা বাঁধ। বক্সার থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত গঙ্গার নাব্যতা অনেকটাই কমে গেছে। ফলে নদীর ধারণক্ষমতা যাওয়ায় দুই পার ছাপিয়ে যাচ্ছে পানি। বাড়ছে বন্যাকবলিত এলাকা। তাই ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর দাবি জানান নীতিশ কুমার।

মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের দাবি প্রসঙ্গে ভারতের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি একসময় ফরাক্কা বাঁধের সমালোচনা করেছি। কিন্তু ১৯৭৫ সাল থেকে বাঁধটি রয়েছে। এতে ফারাক্কা থেকে মোহনা পর্যন্ত পরিবেশ বদলে গেছে।’

বাঁধ নির্মাণের আগেই সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা

ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে ১৮৫১-১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার পানি হুগলী ও ভাগীরথীতে কীভাবে প্রবাহিত করা যায়। প্রতিটি সমীক্ষাতেই বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন, গঙ্গা বা পদ্মার মতো বিশাল নদীর গতিপথে বাঁধ দিলে এর উজান ও ভাটি দুই অঞ্চলেই প্রাকৃতিক ভারসাম্যের গুরুতর বিঘ্ন ঘটতে পারে। এ অভিমত উপেক্ষা করেই ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগীরথীতে সংযোগ দেয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পনা করে।

পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন তখন। তিনি অভিমত দেন, গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০ হাজার কিউসেক পানি ফিডার খাল কিংবা হুগলী-ভাগীরথী ধারণ করতে পারবে না। গঙ্গা ও ভাগীরথীর প্রবাহরেখার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালন কষ্টকর। ফলে স্বাভাবিক প্রবাহ অন্য পথে যাবে। মালদহ ও মুর্শিদাবাদে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। ব্রহ্মপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতিসম্পন্ন নদী। এ ধরনের নদীর গতিপথ আঁকাবাঁকা হয় বলে জলাবদ্ধতা নদীভাঙন সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। ভাটি অঞ্চলে সব নদী নাব্যতা হারাবে। শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দেবে।

প্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্যের অভিমতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তখনকার ভারত সরকার তাকে পাকিস্তানি এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করেছিল। পরে মার্কিন নদী বিশেষজ্ঞ ড. ইপেনকে সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেন। মার্কিন বিশেষজ্ঞ তার প্রতিবেদনে বলেন, ফারাক্কা বাঁধ দিলে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। তারপরও ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে।

১৯৬১ সালে ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৭১ সালে। ১৫৬ কোটি ভারতীয় রুপিতে নির্মিত বাঁধটি ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল চালু হয়। বাঁধের দৈর্ঘ্য ২.২৫ কিলোমিটার সংযোগ খালের দৈর্ঘ্য ৪৩ কিলোমিটার। পানি প্রবাহের মতো ৪০,০০০ কিউসেক গেটের সংখ্যা ১০৯টি। প্রতি গেটের প্রবাহ সমতা ৭০৯ কিউসেক। হুগলী, ভাগীরথীর প্রবেশ স্থান বাঁধের দৈর্ঘ্য ২২৪ মিটার।

পরীক্ষামূলকভাবে চালু করেছিল ভারত

মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ চালু করার অনাপত্তি ‘আদায়’ করা হয়েছিল ঢাকার কাছ থেকে। তারপর সেই পরীক্ষামূলক সময়সীমা আর শেষ হয়নি। গত চার দশকে উজানের গঙ্গায় বরং আরও অর্ধ ডজনের বেশি বাঁধ নির্মিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও সীমান্তের এপাশের অসন্তোষ বহুল আলোচিত।

চার দশকের পরিক্রমায় ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে গঙ্গার ভাটি বা বাংলাদেশ অংশ ভালো নেই। পানিশূন্যতা, ভাঙন জাগানিয়া চর, মৎস্যসম্পদহীনতা, ভূগর্ভস্থ পানির নিম্নগতি, শাখা নদীগুলোর দুরবস্থা, সেচব্যবস্থায় ধস, আরও ভাটিতে সুন্দরবনে মিঠাপানির সংকট, লবণাক্ততার বাড়াবাড়ি- গঙ্গা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশ ভালো নেই।

উজানের অংশও যে ভালো নেই, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের প্রতিক্রিয়া কিংবা প্রস্তাব তার প্রমাণ। গত চার দশকে ফারাক্কা রেখেই কীভাবে দুই দেশ গঙ্গার সুফল পেতে পারে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা, এমনকি সমঝোতাতেও প্রত্যাশিত ফল মেলেনি।



মন্তব্য চালু নেই