সূর্য না ডোবার দেশে রোজা রাখবেন কীভাবে

রমজান মাসে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি পরিহার করা সব মোসলমানের জন্য ফরজ। একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে এই সংযম বলেই তার নৈকট্যলাভের সর্বোত্তম সময়ও হচ্ছে মাহে রমজান। অনেকের কাছে এই সংযম অতিব কষ্টসাধ্য মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তাআলা কোনো ইবাদতই বান্দার ওপর চাপিয়ে দেননি। সাধ্যের অধিক কিছু চাপিয়ে দেন না তিনি। নিচের আয়াতেই সেই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে-

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَآئِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ عَلِمَ اللّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ فَالآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُواْ مَا كَتَبَ اللّهُ لَكُمْ وَكُلُواْ وَاشْرَبُواْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّواْ الصِّيَامَ إِلَى الَّليْلِ وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা নিজদের সাথে খিয়ানত করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। অতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা অনুসন্ধান কর। আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর। আর তোমরা মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না। এটা আল্লাহর সীমারেখা, সুতরাং তোমরা তার নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ মানুষের জন্য স্পষ্ট করেন যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে। (২:১৮৭)

কিন্তু উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ যেখানে ৬ মাস দিন এবং ৬ মাস রাত সেখানে আমাদের দেশের মতো ২৪ ঘণ্টায় একদিন এবং সূর্যাস্ত ও সুবহে সাদিক হিসাব করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঐখানে সূর্যাস্ত ও সুবহে সাদিক আমাদের দেশের হিসাবে ছয় মাস পর পর। সেখানে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরআনের বিধানুযায়ী সিয়াম রাখা সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব।

এর যুক্তিসঙ্গত উত্তরে বলা যায়:

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর। (২: ১৮৫)

ইসলাম কারো ক্ষমতার বাইরে তার ওপর কোনো বিধান প্রয়োগ করে না। সেখানকার বাসিন্দারা স্বাভাবিক কাজকর্ম, পানাহার, ঘুমের জন্য যেভাবে সময় নির্ধারণ করে, সেভাবে নামাজ ও রোজাও করবে।

মুসলিম শরিফে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহকে (সা.) বললেন, ‘ইয়াজুজ-মাজুজের সময় দিন এক বছরের সমান হবে।’ তখন সাহাবারা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, তখন কি একদিনের নামাজ যথেষ্ট হবে? নবী (সা.) বললেন, ‘না, সালাতের জন্য সময় অনুমান করে নিতে হবে।’

যারা পৃথিবীর দুই মেরুতে বসবাস করেন তাদের জন্য দিন-রাতের হিসাবটা আলাদা। এখানে দিন অথবা রাত খুব দীর্ঘ হয়। এমনও হয় টানা ছয় মাস ঝলমলে দিন: সূর্য শুধু ২৪ ঘণ্টা এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে যায় কিন্তু কখনোই অস্ত যায় না। আবার ছয় মাস সূর্যের কোনো দেখা মেলে না।

এ ধরনের অঞ্চলে সূর্যের উদয়-অস্ত সারাবছর ঠিক থাকে না। দেখা যায় দিগন্তে ছোট্ট বৃত্তে সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়। তখন শুধু ওই পাশটা কিছু সময়ের জন্য অতি উজ্জ্বল আর কিছু সময়ের জন্য অনুজ্জ্বল দেখায়। একেবারে অন্ধকার নামে না।

সূর্য যখন একদম খাড়া থাকে তখন মেরুর কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষেরা একে দিন বলেন এবং সাধারণ কাজকর্ম শুরু করেন। সূর্য যখন হেলে পড়া শুরু করে এবং দিগন্তে নেমে যায় তখন স্তিমিত হয়ে পড়ে। একেই তারা বলেন রাত।

এই হিসাব থেকে কিন্তু সহজেই রাত আর দিন নির্ধারণ করা যায়। ভূমিতে একটি লাঠি পুঁতে রাখলে এর ছায়া যখন প্রকৃত দৈর্ঘ্যের একটু বড় হয় তখন যোহর বা দুপুর ও বিকেলের নামাজের সময় হয়। আর যখন সবচেয়ে দীর্ঘ হয় তখন মধ্যরাত। আর এভাবেই দুপুর এবং মধ্য রাত হিসাব করা যায়।

এখন সাধারণ অঞ্চলে যদি দিনের দৈর্ঘ্য জানা থাকে তাহলে সহজেই নামাজ ও রোযার সময় হিসাব করা যায়। যেমন: সাধারণত গ্রীষ্মকালে দিন হয় ১৪ ঘণ্টা আর রাত হয় ১০ ঘণ্টা।

দীর্ঘ দিনের ক্ষেত্রে হিসাবটা সহজ। কিন্তু রাতে একটু সমস্যা হয়। কারণ আবহাওয়া তো সব সময় একরকম থাকে না।

কখনো নিকষ অন্ধকার এবং কখনো হালকা অন্ধকার থাকে যখন সূর্য দিগন্তের কাছাকাছি আসে। আর যখন দিগন্ত থেকে সরে যায় তখন ঘন অন্ধকার হয়। টানা ছয় মাস রাতে অবস্থাটা এরকমই।

রাতে তারা/নক্ষত্রের গতি এবং দিগন্ত থেকে দূরত্ব এবং আলো-অন্ধকারের কমবেশি দেখে দুপুর ও মধ্যরাত নির্ণয় করা যায়। সাধারণ অঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখানেও সেভাবে সময় নির্ধারণ করে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা যায়।

তবে শর্ত থাকে, দিন যেখানে অস্বাভাবিক লম্বা তথা ২০/ ২১ ঘন্টা লম্বা হয়। সেখানেও সে দেশের সময় অনুসারে রোজা পালন করতে হবে। যদি কোনো দিন রোজা পালন অতিরিক্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে, সেদিন রোজা ভঙ্গ করতে হবে এবং পরে কাযা করতে হবে।

ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক (গ্রীনল্যন্ড), রাশিয়া, আইসল্যান্ড, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার কিছু অংশে গ্রীষ্মকালের একটি বড় সময় সূর্য অস্তমিত হয় না যাকে নিশীথ সূর্য (Midnight Sun) নামে অভিহিত করা হয়। কুমেরু বৃত্তের (Antarctic Circle) দক্ষিনে কোন স্থায়ী বসতি না থাকায় সুমেরু বৃত্তের (Arctic Circle) উত্তরাঞ্চলের জনসাধারন সীমিত আকারে এঘটনার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সমর্থ হয়। বস্তুত ফিনল্যান্ডের একেবারে উত্তরপ্রান্তে (Nothernmost point) ৭০ দিনেরও অধিককাল সূর্য অস্তমিত হয় না। অপরদিকে ইউরোপের সর্ব উত্তরপ্রান্ত নরওয়ের স্বালবার্ড (Svalbard) অঞ্চলে ১৯ এপ্রিল থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত চার মাসের বেশি সময় সূর্যাস্ত হয় না। কোন কোন জায়গায় একটানা ছয়মাস পর্যন্ত সূর্য দৃশ্যমান হয়।



মন্তব্য চালু নেই