সুযোগ নিতে ‘সক্রিয়’ হয়েছেন নিষ্ক্রিয় নেতারা

দলের জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে বিএনপিতে দুটি পক্ষ এখন তৎপর। একদল, যাদের বলা হয় ত্যাগী বা সক্রিয়, তারা আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেদের ভূমিকার মূল্যায়ন চান। আরেক দল, যারা গা বাঁচিয়ে দূরে দূরে থেকেছেন, তারা সুযোগ নিতে চান। তবে এত দিন দূরে থাকা এই নিষ্ক্রিয় নেতারাই পদ পেতে এখন বেশি ‘সক্রিয়’।

বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ওই নিষ্ক্রিয় নেতাদের এই সক্রিয়তা মূলত নানামুখী পাঁয়তারায়। কেউ মন দিয়েছেন লবিংয়ে। কেউ সময় দিচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় ও গুলশানের কার‌্যালয়ে। কেউ আবার ছোটখাটো কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নিজের উপস্থিতি জাহির করছেন। আন্দোলন-সংগ্রামের গোটা সময় যাদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যেত, সেসব নেতা এখন নেতাকর্মীদের টেলিফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছেন। আবার হাইকমান্ডের নজর কাড়তে ‘স্বেচ্ছায়’ কারাবরণেরও অভিযোগ আছে কারও কারও বিরুদ্ধে।

তবে এসব পাঁয়তারায় এবার শিকে ছিঁড়বে না বলে জানাচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, আগামী মার্চে অনুষ্ঠেয় কাউন্সিলে দলের আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মীদের ভূমিকা মূল্যায়ন করা হবে এবং তার মাধ্যমে যোগ্যদের স্থান দেয়া হবে কমিটিতে।

দলের এই অবস্থানে অবশ্য আশাবাদী হচ্ছেন ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

খোদ বিএনপির চেয়ারপারসনও নিষ্ক্রিয়দের সরে যাওয়ার জন্য বলেছেন। বলেছেন, যারা আন্দোলন-সংগ্রামে জীবনবাজি রেখে কাজ করেছেন, বেইমানি করেননি, কাউন্সিলে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। আর যারা নিষ্ক্রিয় ও ব্যর্থ, তারা সরে দাঁড়াবেন।

সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল করতে চায় সরকারের দমন-পীড়নে বিপর্যস্ত বিএনপি। সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য ইতিমধ্যে তিনটি ভেন্যু চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া কাউন্সিল আয়োজনের অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ডেও হাত দিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের কাউন্সিল উপলক্ষে ১২টি কমিটি করা হয়েছিল। এবারও ওই সব কমিটি বহাল রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। তবে কিছু কমিটিতে পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন- অভ্যর্থনা কমিটির দায়িত্বে ছিলেন প্রয়াত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। এবার সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। ব্যবস্থাপনা কমিটিতে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। কিছুদিন ধরে তিনি কারাগারে। কাউন্সিলের আগে তিনি মুক্তি পাবেন বলে আশা করছে বিএনপি। এ ছাড়া আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। দীর্ঘদিন ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে এসব জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানা গেছে।

বিএনপির সূত্র জানায়, কাউন্সিলে এবার গঠনতন্ত্রে সবার মতামতের ভিত্তিতে বেশ কিছু সংযোজন-বিয়োজন হবে। তাই সাংগঠনিক কাঠামোতে কয়েকটি নীতিগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মতবিনিময় সভা ও দলীয় ফোরামে উত্থাপিত কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাবগুলো হলো- এক নেতা এক পদ নীতিতে কমিটি গঠন, জাতীয় নির্বাচনে এমপি প্রার্থীদের স্থানীয় কমিটির পদে না রাখা, জাতীয় নির্বাহী কমিটির পরিধি কমানো, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীকে বিএনপির উপদেষ্টামণ্ডলীতে পরিণত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের জন্য আলাদা আলাদা পরামর্শক কমিটি গঠন।

সূত্র জানায়, পঞ্চম কাউন্সিলের পর ইতিমধ্যে দলের স্থায়ী কমিটিসহ ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকমণ্ডলী ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা মারা যাওয়ায় এবং দলত্যাগ ও বহিষ্কারের ঘটনায় কিছু পদ খালি হয়েছে। এ ছাড়া বহুদিন ধরে কাউন্সিল না হওয়ায় অনেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়েছেন। এসব শূন্যস্থান পূরণের জন্য এবার ছাত্রদল আর যুব সংগঠন থেকে যোগ্যদের মূল দলে অন্তর্ভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্তও রয়েছে দলটির। এর পাশাপাশি এত দিন কোনো পদ-পদবিতে না থেকেও দলের জন্য কাজ করেছেন, এমন নেতাকর্মীদেরও পুরস্কৃত করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।

কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর যেসব নেতা দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবেদিন ফারুক, সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়ের ভূইয়া, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ।

শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা যারা খুব বেশি দল ও সহযোগী সংগঠনের কর্মসূচিতে আসতে রাজি হতেন না, তারাও এখন নিয়মিত আসছেন। কেউ কেউ গুলশান কার‌্যালয়ে গিয়ে খালেদা জিয়াকে সালাম দিয়ে নিজেদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এ ছাড়া সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার‌্যালয়ে নিয়মিত সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি সময় দিতে দেখা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার নয় মামলায় আদালতে হাজির হলে জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় কারাগারে পাঠানো হয় এ্যানীকে। এর দুই দিন আগে তিনি ‘কয়েকটা দিন কারাগারে কাটিয়ে আসি’- ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের কাছে এমন কথা বলেছেন বলে অভিযোগ আছে।

গুলশান কার‌্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “রাত হলে কার‌্যালয় লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। হরতাল-অবরোধ তো দূরের কথা, ভালো সময়েও যাদের দেখা যেত না এমন সাবেক অনেক এমপি, এমপি প্রার্থী ছিলেন এমন নেতারা তাদের অনসারীদের নিয়ে আসছেন। ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) কার‌্যালয়ে অনেক রাত পর‌্যন্ত অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন,“আগের মতোই বড় পরিসরে কাউন্সিল করার চিন্তা চলছে। সে ক্ষেত্রে কারও পদ হারানো আবার কারও পদ পাওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে এবার লবিং-তদবিরে পদ না দেয়ার পক্ষে চেয়ারপারসন কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। আবার যারা কাজ করেছেন তারা মূল্যায়িত হবেন এটাই স্বাভাবিক।”



মন্তব্য চালু নেই