সিলেটে অজানা রোগে একই পরিবারের ২২জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী

বংশ পরম্পরায় তারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কেউ কেউ জন্মগত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। আবার কেউ কেউ বিয়ের পর অন্ধ হয়ে যান। যেভাবেই হোক একই পরিবারের ২২জন প্রতিবন্ধী। গ্রামে এক ঘরে না করলেও পরিবারটির সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চায় না কেউ। এলাকায় তারা পরিচিত ‘কানাগুষ্টি’ হিসেবে। তবে তাদের অন্ধত্বের কারণ জানা যায়নি।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইছাকলস ইউনিয়নের পুটামারা গ্রামে প্রতিবন্ধী এ পরিবারটির বসবাস। সিলেট নগরী থেকে গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। গ্রামটি অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন।

পরিবারের সদস্য ও গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মরহুম আরজু মিয়ার পরিবারের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হন। আরজু মিয়াও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। এরই ধারবাহিকতায় তার ছেলে খুরশিদ আলী (৭৫) ও মেয়ে জয়তেরাও ( ৬৫) দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে যান। বর্তমানে সবমিলিয়ে এই পরিবারে ২২ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এদের মধ্যে কয়েকজন জন্মগত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং আবার অনেকে বিয়ের পর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েছেন।

খুরশিদ আলী জানান, তার বংশের পূর্ব পুরুষরা অন্ধ ছিলেন। তার বাবা আরজু মিয়া, তিনি ও তার বোন জয়তেরার জন্মের পর থেকেই চোখের সমস্যা ছিল। ধীরে ধীরে তারা একেবারেই অন্ধ হয়ে যান। তার ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে তিনজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।

জয়তেরার বিয়ের পর দৃষ্টি হারান তার স্বামী আম্বর আলী। এই দম্পতির ছেলে ঠাণ্ডা মিয়া, মেয়ে জবা বেগম, রোশনা বেগম এবং নাতনি রহিমা বেগমও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।

খুরশিদ আলীর চাচাতো ভাই আব্দুর নুরের পরিবারে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রয়েছেন ৫ জন। তাদের আরেক চাচাতো ভাই তহুর আলীর পরিবারে রয়েছেন ৩ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তহুর আলীর ছোট বোন মৃত রাজিয়া বেগমও ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তারই ছেলে সুন্দর আলীও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।

পুটামারা গ্রামের স্কুল শিক্ষক তেরা মিয়া জানান, পরিবারটির লোকজনের সঙ্গে কেউ সম্বন্ধ করতে চায় না। বিয়ের পর তারা অন্ধ হয়, প্রথমে তাদের মাথা ব্যথা হয়। এরপর তাদের চোখে সাদা পর্দার মতো পড়ে। এক পর্যায়ে দৃষ্টি শক্তি হারান তারা।

তিনি জানান, এ ধরনের কয়েকজন রোগীকে নিয়ে তিনি সিলেটে বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসারা তাদের চোখের কোনও ত্রুটি বের করতে পারেননি। অনেক সময় পীর-কবিরাজরা এ রোগের বিষয়ে নানা কল্প কাহিনী শোনায়। তবে, কোনও কিছুই রোগ শনাক্তের ব্যাপারে কাজে আসছে না।

সিলেটের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান ডা. মোশাহিদ ঠাকুর বলেন, জেনেটিক কারণে অর্থাৎ বংশ পরম্পরায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা হয়। একইভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও অনেক সময় পরিবারের এক সদস্য থেকে অন্য সদস্যদের হতে পারে।

তিনি বলেন, দারিদ্র্য পীড়িত উন্নয়নশীল অঞ্চলে অন্ধত্বের প্রধান কারণ হচ্ছে-হাম এবং ভিটামিন ‘এ’-র ঘাটতি। প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত স্থানীয় ওষুধ, নবজাতকের চক্ষু প্রদাহ এবং হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার ফলেও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বৈকল্য, অপরিণত বৃদ্ধি এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও এসব রোগীর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ার পেছনের কারণ থাকতে পারে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী আলমগীর কবির জানান, তিনি গত কিছুদিন আগে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। বিষয়টি তার জানা নেই। এ বিষয়ে তিনি খোঁজ খবর নেবেন।

সরকারি সাহায্য ও ভাতাদি প্রসঙ্গে খুরশিদ আলীর ছেলে আনছার মিয়া বলেন, এখনও তারা কোনও প্রতিবন্ধী ভাতা বা বয়স্ক ভাতা পাননি। চেয়ারম্যান মেম্বারের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যম ও এনজিও সংস্থা তাদের ছবি ও তথ্য নিয়ে যায়। পরে তারাও আর খবর রাখেন না।

ইছাকলস ইউনিয়নের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান কুটি মিয়া বলেন, সরকারি সাহায্য ও ত্রাণের অপ্রতুলতার কারণে খুরশিদ আলীর পরিবারে তেমন কোনও সহযোগিতা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। তবে আগামীতে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী ভাতা ও বয়স্ক ভাতা প্রদানের চেষ্টা করবেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই