সিটি নয় জাতীয় নির্বাচনে দৃষ্টি বিএনপির

ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে অন্যদের তোড়জোড় আর প্রস্তুতি চললেও তা নিয়ে মাথাব্যাথা নেই বিএনপির। কারণ, দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলমান আন্দোলনের ফল তুলে আনা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করার দিকেই দৃষ্টি দলটির।

এ জন্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিষয়টিকে এক প্রকার ডার্কসাইটে রেখে চলছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। কর্মসূচিতে নতুনত্ব আনাই এই মুহূর্তে দলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন তারা।

যেমনটি বলছিলেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান।  তিনি বলেন, বর্তমান বাংলাদেশে একটি বড় রাজনৈতিক সংকট চলছে। এই সংকট নিরসনে জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। সেজন্য অন্য কোনো নির্বাচনের দিকে তাকানোর সুযোগ নেই, বরং জাতীয় নির্বাচন কত তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে দেশের মানুষের আগ্রহ।

‘আঞ্চলিক নির্বাচন এই মুহুূর্তে অপ্রয়োজনীয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। দলের দৃষ্টি সব দলের অংশগ্রহনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের দিকে। যেই নির্বাচনে গণতন্ত্র সুসংহত হবে, সুশাসন ফিরে আসবে এবং জনগনের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সত্যিকারের সংসদ হবে। এই দাবি আদায়ে আন্দোলনে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছে বিএনপি।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ জন্য যে কোনো সময়ে কমিশনের জরুরি বৈঠক বসতে যাচ্ছে। এ সভায় নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণের পরই তফসিল ঘোষণা হতে পারে। ইতিমধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করতে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। সার্বিক প্রস্তুতি সন্তোষজনক হলে আগামী মে-জুন মাসেই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন করতে চায় কমিশন।

এ উপলক্ষে সোমবার পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। বৈঠকে বিএনপি জোট অবরোধ-হরতাল চালিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তিন সিটি কর্পোরেশনে ভোট আয়োজনের মত দিয়েছেন পুলিশ প্রধান। বৈঠকে ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও উপস্থিত ছিলেন।

আইজিপি বলেন, ‘আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে। কমিশন নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সহায়তা চাইবে, আমরা সর্বাত্মক সহায়তা করব।’

তবে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপিকে চাপে রেখে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন করতে চায় সরকার। এর উদ্দেশ্য ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে নগরের ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া। চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় হঠাৎ করেই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উদ্যোগকে আওয়ামী লীগের ‘ষড়যন্ত্রের টোপ’ হিসেবে দেখছেন তারা। আন্দোলন বিঘ্নিত করতে এবং তা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরাতেই আকস্মিকভাবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে আনা হয়েছে বলে মনে করেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।

তাদের মতে, সরকার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে অনেক ‘নাটক’ করেছে। এর আগে বিএনপি বারবার চাইলেও মোয়াদোত্তীর্ন কর্পোরেশনের নির্বাচন দেয়নি সরকার। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন চলাকালে হঠাৎ করেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা বিএনপির আন্দোলনে প্রভাব ফেলতে চায়। একই সঙ্গে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরাতে চায়। কিন্তু বিএনপি সরকারের এ ‘ষড়যন্ত্রে’ পা দেবে না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী আন্দোলনের কৌশল পাল্টে বিএনপি নির্বাচন নিয়ে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

বিএনপির একজন প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যান  বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই সরকার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনেও বিএনপিকে বাইরে রাখতে চায়। সেজন্য হামলা-মামলা-গ্রেফতারে জর্জরিত বিএনপি নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি নিতে পারবে না ধরে নিয়ে নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সেই ফাঁদে পা দেবে না বিএনপি। এইমুহূর্তে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে দল ভাবছেনা। তবে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পরিস্থিতি বিবেচনায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতেও বিএনপি ভূল করবেনা বলেও জানান তিনি।

‘পরিস্থিতি বিবেচনায় তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত বলতে কি বোঝোচ্ছেন’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেনা কোনো প্রার্থীও দেবেনা। তবে নাগরিক কমিটির ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যে কাউকে বিএনপি অদৃশ্য সমর্থন জানাতে পারে।

সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির অনাগ্রহের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি সমর্থিত স্থানীয় মেয়ররা ভূমিকা রাখতে পারছেনা। অবরোধ-হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। কেউ হয়েছেন গ্রেফতার। এ সুযোগে তাঁদের জায়গায় ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্যানেল মেয়রের তালিকায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা।

আরিফুল হক, মোসাদ্দেক হোসেন, এম এ মান্নান একের পর এক মামলায় জড়িয়ে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিএনপির এসব নির্বাচিত মেয়রদের। ইতিমধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার কারণে রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন পলাতক রয়েছেন। আর খুলনার মেয়র মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। ‘অসুস্থতা’র কারণে এক মাস ধরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নানকে সম্প্রতি ঢাকার বারিধারার বাসা থেকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

২০১৩ সালের জুনে রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল এবং পরের মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। পাঁচটিতেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের টানা আন্দোলন কর্মসূচির কারণে নির্বাচিত এই মেয়রদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে এবং তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় মেয়র পদ নিয়ে বিএনপির আগ্রহ নেই বললেই চলে। বরং দাবি অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনে জন্য সরকারকে সংলাপের বাধ্য করার দিকেই দৃষ্টি তাদের।

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, জাতীয় সংসদ আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন এক নয়। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চলমান রাজনৈতিক সংকটে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

আন্দোলন বিঘ্নিত করতে এবং তা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরাতেই আকস্মিকভাবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘ভীত সরকার আন্দোলন বাধাগ্রস্থ করার অপচেষ্টা হিসেবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেজন্য অনেক আগেই এই নির্বাচন ডিও (মেয়াদোত্তীর্ন) হয়ে যাওয়ার পরও সরকার নির্বাচন দেয়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই কথা নেই, বার্তা নেই নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে।’

নগরের দখল নিতেই এমনটি করা হচ্ছে, দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা অনেকবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথা বলেছিলাম, কিন্তু তখন দেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশন মেরুদন্ডহীন। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। সেজন্য পুলিশের প্রধান বলেন, নির্বাচন কখন ভালো হবে। এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনিক।’

নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। এর আগে অন্য সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। তবে এবাবের নির্বাচনটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছেনা, ষড়যন্ত্র আর কৌশলের অংশ হিসেবে হচ্ছে। বিএনপি এ নিয়ে এখানো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।’রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই