সাড়ে তিন হাজার নাটক সমগ্র নিয়ে নাট্যাভিনেতা তোফা ই-লাইব্রেরির স্বপ্ন

সময়ের সঙ্গে মানুষের পড়ার অভ্যাস কমছে, কথাটি কতটুকু সত্য তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকতে পারে। তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের পড়ার অভ্যাসটি অনেকটাই বদলে গেছে। আগে যেখানে লাইব্রেরিতে গিয়ে কিংবা লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে ঘরে আরাম করে পড়ার দৃশ্যদেখা দেখা যেত। সেখানে বই পড়তেই এখন মানুষের হাতে এসে পড়েছে ই-বুক রিডার, স্মার্টফোন কিংবা ট্যাবলেট পিসি। কম্পিউটার বা ল্যাপটপের পর্দাতেই এখন কেবল ছবি দেখা বা গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যই নয়, বই পড়ার জন্য ও তাকিয়ে থাকেন অনেকেই।

ক্রমান্বয়ে মানুষের হাতে স্মার্টফোন আর দ্রুতগতির ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়ায় স্মার্টফোনেও বই পড়ার হার বেড়েছে । সব মিলিয়েই অনলাইনে বই খোঁজে নিজস্ব চাহিদা পূরণের লক্ষে অনেকেই সময় ব্যয় করে থাকেন। এর বাইরে ই-কমার্সের বদৌলতে অন্যান্য পন্যের মতো বইও কেনার সুযোগ রয়েছে অনলাইনে। ফলে যে যার ঘরে বসে পছন্দের বইটি কেনার সুযোগ ও পাচ্ছেন খুব সহজেই।

লাইব্রেরি কথাটির সাথে আমারা সকলেই কোন না কোনভাবে জড়িত রয়েছি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল গণ্ডি পেরিয়েও রয়ে যায় লাইব্রেরির শখ। এই শখ থেকেই হয়তো লাইব্রেরিকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে ফেলেন প্রমথ চৌধুরী। ডিজিটাল বিশ্বের এই যুগে লাইব্রেরিকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দিতে আরো সহজ করতে ই-লাইব্রেরির স্বপ্নে বিভোর একজন নাট্যপ্রেমী। যাকে একাধারে বলা যায় নাট্যপ্রেমী, গ্রন্থপ্রেমী মানুষ। তিনি নাটকের সমগ্র (নাট্যগ্রন্থ) পড়তে ভালোবাসেন। তাই দেশি বিদেশি লেখকদের লেখা নাটকের সমগ্র সংগ্রহ করেন। বর্তমানে তার সংগ্রহে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, শরবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, অলোক রায়, শুম্ভ মিত্র, মনোজ মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, নভেন্দু সেন, চন্দন সেন, লোকনাথ ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় বৈরাগী, ব্রাত্য রাইসু, সেলিম আল দীন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, হুমায়ূন আহমেদ, মান্নান হীরা, মমতাজউদ্দীন আহমদ, রামেন্দ্র মজুমদার, আলী যাকের, আহম্মেদ সফা, আবুল হোসেন, সিকান্দার আবু জাফর, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সহ দেশি বিদেশি খ্যাতিমান সব লেখকদের বাংলা ভাষায় লেখা নাটকের প্রায় সাড়ে তিন হাজার নাটক সমগ্র।

১৯৭৫ সালের ৫ জুলাই নওগাঁ জেলার কশব ইউনিয়নের মোঃ কমর উদ্দীন শাহানা এবং মোসাঃ মনোয়ারা বেগমের কোল জুড়ে আসেন নজরুল ইসলাম তোফা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় তোফা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালীন থেকেই বই সংগ্রহের নেশা তার। তার সংগ্রহে রয়েছে তার প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনে কেনা সব বই-ই। তোফা গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী আর চকউলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে এস এস সি পাশ করেই এইচ এস সি সমমান হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি এফ এ (প্রাক) কোর্সে চারুকলায় ভর্তি হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে পড়াশোনা শেষ করে রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অভিনয় করেন। তারপর প্রচণ্ড স্বপ্নবাজ এ গ্রন্থ-প্রেমী নাট্যাঙ্গনে নাটক নির্মাণে মগ্ন হন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নাট্যকার ও পরিচালক শিমুল সরকারকে সঙ্গে নিয়ে নাট্যদুয়ার নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ খোলা হয়। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলার উপর বিএফএ এবং এমএফএ পাশ করেন।

তিনি বাস্তবে একজন নাট্যাভিনেতা হলেও তার বইয়ের প্রতি রয়েছে প্রচণ্ড আগ্রহ। তাই তিনি আস্তে আস্তে হয়ে উঠেন গ্রন্থপ্রেমীও। তবে তার নাটকের সমগ্র সংগ্রহের নেশা তৈরি হয় ১৯৯২ সালের দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগে ভর্তি হবার পর।

নাটকের গ্রন্থ সংগ্রহের কথা বলতে গিয়ে নজরুল ইসলাম তোফা বলেন, ২০১০ সালে আমি যখন ধারাবাহিক নাটক ‘চোর কাব্য’তে কাজ করি তখন শ্যুটিং এর জন্য ঢাকায় ছিলাম। সেজন্য ‘টিভি নাটক সমগ্র’ গ্রন্থটি সংগ্রহ করার জন্য আমি নীলক্ষেতে যাই। সেখানে গিয়ে আমাকে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রিকশায় লেগে আমার পরনে থাকা শার্ট ছিঁড়ে যায়। আমি ছিঁড়া শার্ট পরেই মার্কেটের ভিতরে ঘুরতে থাকি গ্রন্থটি কেনার জন্য। মন কিছুটা খারাপ হলেও শার্ট কেনার জন্য কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ তখন শার্টের চেয়ে গ্রন্থটি বেশি প্রয়োজন ছিল।

আবেগতাড়িত কন্ঠে তিনি আরো বলেন, আর একটা বিষয় হলো সেই সময় চাইলেই হয়তো শার্ট কিনতে পারতাম, তবে শার্ট কিনলে গ্রন্থটি কেনার টাকা হতো না। কারণ ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরার টাকা ব্যতিত পকেটে তখন ছিলো মাত্র পাঁচশো টাকার মত।

তিনি বলেন, বই সংগ্রহের বড় শক্তি ছিলেন আমার বাবা। গ্রন্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আমার বাবা হঠাৎ একদিন বলে বসেন এতো বই সংগ্রহ করছো কি হবে? উত্তরে আমি বলি, ‘বই আমার রক্তে, সংগ্রহ না পড়তে পারলে অসুস্থ হয়ে পড়ি। জীবনের অপূর্ণতাকে কাটিয়ে উঠার সহায়ক হচ্ছে আমার বই। তাছাড়া তুমি তো যখন থাকবে না, তখন আমার ছেলেকে বলবো, আমার বাবা আমাকে এই লাইব্রেরি করে দিয়েছে’। নজরুল ইসলাম তোফার বাবা সেই সময় কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, তোমার চিন্তা চেতনার জায়গায় বুঝি আমি! তারপর বাবা বই সংগ্রহ নিয়ে কোন কথা বলেননি।

গ্রন্থ সংগ্রহ করতে করতে বর্তমানে তার সংগ্রহে শুধুমাত্র নাটকের সমগ্র গ্রন্থ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। তার সংগৃহীত বইয়ের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান লেখকদের বাংলা ভাষায় লেখা নাট্যসমগ্র ও বাংলা অনুবাদ নাট্যসমগ্র গ্রন্থ। সেই গ্রন্থগুলো দিয়ে নিজের বাড়িতে তৈরি করেছেন একটি সংগ্রহশালা। শুধু তাই না সেই গ্রন্থগুলোকে ক্রমিক নম্বরের আওতায় এনে একটি ডায়রিতে লিপিবন্ধ করে রেখেছেন।

কেন তিনি এতো নাট্যসমগ্র সংগ্রহ করেছেন ও এখনো সংগ্রহ করে যাচ্ছেন এবং সেগুলোকে সযত্মে সংরক্ষণ করেন জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম তোফা বলেন, আমি ছোট বেলা থেকেই নাটক করি আর নাটকে অভিনয় করতে ভালোবাসি। স্কুলে পড়াকালে মঞ্চ নাটকের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় আমার নাটক বা অভিনয় করা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর নাট্যগুরু পরিচালক শিমুল সরকারের সঙ্গে থিয়েটারে যুক্ত হই। এভাবে নাটক করতে করতে একসময় টিভি নাটকে কাজের সুযোগ পাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাজ করার সময় নিজের ভিতরে কিছু অপূর্ণতা আছে বলে মনে হয় আমার। সেই অপূর্ণতাকে কাটিয়ে উঠতে আর নাটক ও অভিনয় সম্পর্কে আরো বেশি জ্ঞানার্জনের লক্ষে বিভিন্ন খ্যাতিমান নাট্যকার ও লেখকদের লেখা নাট্যগ্রন্থ সংগ্রহ করে পড়তে শুরু করি। এভাবেই আমার সংগ্রহে জমা হতে থাকে একের পর এক নাট্যগ্রন্থ।

এসব নাট্যগ্রন্থ নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু করার কোন পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তোফা বলেন, এসব কাগজের গ্রন্থ তো বেশিদিন অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করা সম্ভব না। সে জন্য এসব মূল্যবান গ্রন্থগুলোকে অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করার জন্য আমি এগুলোকে ই-বুকে রূপান্তরিত করে ই-লাইব্রেরি (অনালাইন আর্কাইভ) তৈরির পরিকল্পনা করছি। যাতে সযত্নে নিজের সংগ্রহে রাখার পাশাপাশি গ্রন্থগুলোর দ্বারা অন্যদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি।

সংগ্রহের মধ্যে কার লেখা গ্রন্থ ভালো লাগে বললে তোফা বলেন, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক সংগ্রহ গ্রন্থের ‘স্বর্গে কিছুক্ষণ’ নাটকের একটি সংলাপ, “শুনেছো ঠিকই শুনেছো। কেন সুনাম থাকবে না বলো? কতকাল ধরে কৃতিত্বের সঙ্গে এ কাজ করে আসছি” এ সংলাপটি আমার অনেক ভালো লাগে। তাই মাঝে মধ্যেই এ গ্রন্থটি পড়ে মজা পাই। যেখানে যে অবস্থায় থাকি, সংগ্রহের নেশা আর অভিনয় হৃদয়ে সব সময় কলরব করে।



মন্তব্য চালু নেই