সাজাপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা সরকারি বাসায় আত্মগোপনে!

অর্থ আত্মসাতের দায়ে সাজা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও দিব্যি সরকারি বাসায় আত্মগোপনে রয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বরখাস্তকৃত সহকারী পরিচালক মফিজুর রহমান। অথচ পুলিশ নাকি তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না! ফলে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি রাজস্ব কর্মকর্তা (পরিসংখ্যান) মফিজুর রহমান এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে গত ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এর আগে চলতি বছরের ২৬ জুলাই হেপ্টাগন ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলার রায়ে আদালত ১৮ মাসের কারাদণ্ড ও ৪৪ লাখ টাকা জরিমানা করেন মফিজুরকে।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হলেও তা খারিজ করে পূর্বের রায় বহাল রাখেন আদালত। এরপরই আদালত থেকে আসামি ধরার জন্য গ্রেফতারি পরয়োনা জারি করা হয়।

শুধু ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎই নয়, চাকুরি দেওয়া, রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা, কৃষি জমিতে শিল্প উন্নয়নের জন্য ঋণ করিয়ে দেওয়া, দেশের বাইরে থেকে কৃষি পণ্য আমদানি করতে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলে দেওয়া কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাৎ- এমন নানা কৌশলে অন্তত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। আর তাই প্রতারিত হওয়া মানুষগুলো প্রায় প্রতিদিন পাওনা টাকা পাওয়ার আশায় এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগে ভিড় জমায়। কিন্তু পলাতক আসামি মফিজুরকে এখনো খুঁজে বের করতে পারছে না পুলিশ!

রাজধানীর রমনা থানার ওপরেও মফিজুর রহমানকে গ্রেফতারের ভার পড়েছে। সেই থানার এএসআই নগেন্দ্রনাথ বলেন, ‘গ্রেফতারি পরোয়ানা পাওয়ার পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু এখনো তাকে (মফিজুর রহমান) গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

জানা গেছে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখন মফিজুর রহমান বাংলামোটরের (২৫৭ নিউ ইস্কাটন) সরকারি বাসা টগর ভিলায় দিব্যি বসবাস করছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ওই বাসার দারোয়ানকে টাকা খাইয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন মফিজুর। তাই কেউ খুঁজতে আসলে দারোয়ানের উত্তর একটাই, স্যার এ বাসায় থাকেন না।

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এনবিআরে চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মফিজুর রহমান। এর মধ্যে নরসিংদীর ভূইয়া নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ লাখ, জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে ৬ লাখ, গোপালগঞ্জের ছকিনা বিবির কাছ থেকে ১ লাখ, অবসরপ্রাপ্ত ভূমি কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে ৩ লাখ ও এক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে ১ লাখ টাকাসহ প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে এ পর্যন্ত মফিজুরের বিরুদ্ধে এনবিআরে অভিযোগ এসেছে। এ রকম অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনই আসছে।

এমনকি স্যামসাং বাংলাদেশের সঙ্গে মফিজুর রহমান কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিতে ২০ কোটি টাকার এক চুক্তি করেছিলেন। এর মধ্যে বেশ কিছু টাকা অগ্রিম হিসেবে গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া ওয়ান ব্যাংক, দিলকুশা শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা, প্রাইম ব্যাংকের মতিঝিল শাখা থেকে ১১ লাখ ও আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার নামে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই অর্থ আদায় করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে প্রায়ই এনবিআরে কর্মকর্তা আসেন বলেও প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।

অন্যদিকে রাজস্ব কর্মকর্তা মফিজুর রহমানকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে এনবিআরে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি বিধিমালা অনুয়ায়ী কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করতে পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পর পর তিনটি নোটিশ দেওয়ার রীতি রয়েছে। এরই মধ্যে দুটি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরপর শেষ নোটিশ দেওয়ার মাধ্যমে ওই রাজস্ব কর্মকর্তাকে চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হবে।

২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে হেপ্টাগন ট্রেডিংয়ের দায়ের করা মামলায় ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত মফিজুর রহমানকে ১৮ মাসের কারাদণ্ড ও ৪৪ লাখ টাকা জরিমানার সাজা দেন।

এ বিষয়ে জানা যায়, এনবিআরের সহকারী পরিচালক মফিজুর রহমান হেপ্টাগন ট্রেডিং থেকে ব্যবসায়িক কাজে ২৫ লাখ টাকা নেন। বিপরীতে ২৫ লাখ টাকার চেক দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই টাকা চাইলে টালবাহানা শুরু করেন।

টাকা ফেরত না দেওয়ায় মফিজুর রহমানের নামে হেপ্টাগনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পৃথক তিনটি চেক প্রতারণা মামলা করেন (মামলা নং সিআর-৯৪২/১৪, সিআর-৯৪৩/১৪, সিআর-৯৪৪/১৪)। তিনটি পৃথক মামলায় আদালত তাকে ছয় মাস করে ১৮ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৪৪ লাখ টাকা অর্থদণ্ড করেন।

মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বাইরেও রয়েছে স্বর্ণ চোরাচোলানে জড়িত থাকার অভিযোগ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে বিমানের ডিজিএমসহ ১০ স্বর্ণ চোরাকারবারি গ্রেফতার হন। ওই সময় গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেন। এর মধ্যে মফিজুর রহমানের নাম রয়েছে বলে অন্য ‌একটি সূত্র জানিয়েছে।রাইজিংবিডি



মন্তব্য চালু নেই