সাকা-মুজাহিদের ফাসি ॥ জল্লাদ শাহজাহানের ১০০ বছরের সাজা মওকুফ!

আসামির পরিচয় ছাপিয়ে এখন তার পরিচয় জল্লাদ হিসেবে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরে রাজুর সঙ্গে জল্লাদের ভূমিকা পালন করে শাহজাহান। শাহজাহান এখন আলোচিত একটি নাম।

গতকাল মন্ত্রিসভা বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে তাকে নিয়ে। নানা কাহিনীতে ভরপুর প্রধান জল্লাদ মো. শাহজাহান ভূঁইয়ার জীবন। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের কিছুটা সময় মসৃণভাবে কেটেছে। যৌবনে পদার্পণের পরই যোগ দেয় চাকরিতে।

এ চাকরি তাকে তিন বছরের বেশি ধরে রাখতে পারেনি। জড়িয়ে যায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১টি অস্ত্র মামলা, ১টি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা।

বিচার কাজ দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১৭ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে কাটিয়েছে শাহজাহান। ১৯৯৫ সালে সব মামলায় তার সাজা হয় ১৪৩ বছর। পরে ১০০ বছর জেল মাফ করে তাকে ৪৩ বছরের জেল দেয়া হয়।

এ পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছে। এ কারণে দিন দিন তার সাজার মেয়াদ কমছে। দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে কারাবন্দি। আগামী কয়েক বছর জেল খাটার পরই তার মুক্তি মিলবে। শাহজাহানের জেল কার্ডের ওপর লেখা রয়েছে “ডেট অব রিলিজ ২০৩৫”। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মুখে মুখে জল্লাদ শাহজাহানের এসব কাহিনী আলোচিত হচ্ছে। জল্লাদ শাহজাহান একসময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জল্লাদ শাহজাহান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ ঘাতককে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছেন। এরপর ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরে জল্লাদের ভূমিকা পালন করে।

এ ছাড়া কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ শাহজাহান।

তিনিই একমাত্র জল্লাদ যিনি একরাতেই দুই কারাগারে ৪ আসামিকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছেন। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ১৯৫০ সালের ২৬শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন মো. শাহজাহান ভূঁইয়া ওরফে জল্লাদ শাহজাহান।

তার জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। বাবা হাসান আলী ভূঁইয়া ও মাতা সবমেহের। এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত। পড়াশোনা শেষ করার আগেই তিনি চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু তিন বছর চাকরি করার পর ঊর্ধ্বতনদের ধমক সহ্য করতে না পেরে বাড়ি চলে আসেন।

এরপর ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তার চাকরি চলে যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার চার বছর পর নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব নেন। তার কর্মকাণ্ডের কারণে কেন্দ্র থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়। রাজনীতিতে থাকার সময়ে শাহজাহানের গ্রামে নারীঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। শাহজাহানের দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে।

গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসানো হয়। ওই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণ করে সাজা দেয়া হয়। এরপর থেকেই তার হিংস্রতা বাড়তে থাকে। শাহজাহান অপমান সহ্য করতে না পেরে অপরাধ জগতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। পাশাপাশি অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছার কথা জানান দিতেন।

নারীঘটিত ওই ঘটনার পরে তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। এ ছাড়া ওই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যে কোন অপারেশনে তার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে।

১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায় একটি অপারেশনের নেতৃত্ব দেন শাহজাহান। সেখানে অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে।

মানিকগঞ্জে পুলিশ চেক পোস্ট বসালে শাহজাহান ওই এলাকায় তার বাহিনী মারফত সংবাদটি জেনে যান। সব কিছু জেনে ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন শাহজাহান। সারা রাত পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করে ঢাকায় ফেরেন তিনি।

কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। ঢাকা থেকে নিজের এলাকা নরসিংদীর উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় রাস্তায় তাকে পুলিশ আটক করে। এরপর থেকে তার বন্দি জীবন চলছে। জেলখানায় তার চলাফেরা ও সাহসিকতা দেখে ১৯৮৯ সালে সহযোগী জল্লাদ হিসেবে শাহজাহানকে নিয়োগ করে জেল কর্তৃপক্ষ।

ওই বছরই তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এটাই তার জীবনের প্রথম কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেয়া।

তার যোগ্যতা দেখে ৮ বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদ হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন। এ ছাড়া ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি মনিরকে, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে, ২০০৪ সালের ১০ই মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদারকে, ২০০৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তারকে, ২০০৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণকে, ২০০৭ সালের ২৯শে মার্চ কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুনকে, ২০১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদকে ফাঁসি দেন। তার উল্লেখযোগ্য ফাঁসির মধ্যে- ২০১৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেন।

এরপর সর্বশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করেন। সর্বশেষ দুই জনকে ফাঁসি দেয়ার সময় তার সহযোগী ছিলেন ইকবাল, মাসুদ, আবুল, মোক্তার, রাজু ও হযরত।

এ নিয়ে ৪৭ জনের গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়েছেন এ জল্লাদ। এদিকে জেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ছয় জন সহযোগী লাগে। ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। এ ছাড়া কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। -মানবজমিন



মন্তব্য চালু নেই