সাইবার হ্যাকে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা চরমে

পুতিন আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কখন সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার সময় এবং জায়গা উল্লেখ না করে ওবামা বলছেন, যখন আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থায় কেউ আঘাত করে তখন আমরা তাকে ছেড়ে দেই না। এক্ষেত্রেও সেটার ব্যত্যয় হবে না। তবে সময় ও জায়গা হয়ত এখনই বলা যাচ্ছে না। এনপিআর নামক একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে টেলিফোন সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন এই বার্তা দিলেন তখন তার ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ আছে মাত্র এক মাসের বেশি কিছু। জানুয়ারির ২০ তারিখ শপথ নেবেন নতুন প্রেসিডেন্ট, যাকে জয়ী করতেই রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় দপ্তর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী তথ্যাদি হ্যাক করে উইকিলিকস-এ সরবরাহ করা হয়েছিল। এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে সিআইএ-সহ ১৭টি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা।

বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সরকারের মনোভাব আরো স্পষ্ট করে জানাতে গিয়ে মুখপাত্র জন আর্নেস্ট বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই জানতেন রাশিয়া হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত এবং তিনি ঘোষণা দিয়ে রাশিয়াকে আহ্বান জানিয়েছিলেন এই কাজ করার জন্য। মুখপাত্র জন আর্নেস্ট সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি প্রতিহিংসামূলক একটি রাষ্ট্রকে হ্যাকিংয়ের জন্য সাধুবাদ জানিয়েছিলেন, নির্বাচনে শুধুমাত্র জয়ী হতে এবং হিলারির বিপরীতে মাঠে ইস্যু সৃষ্টির জন্যে।

বিষয়টি এমন যে, নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে রাশিয়ার এই হ্যাকিংকে উল্লেখ করে এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের উপর বহির্বিশ্বের আক্রমণের সঙ্গে মিলিয়ে, বলা হচ্ছে, এটা একটা রাজনৈতিক নাইন ইলেভেন। এ নিয়ে যেন বিস্ময় কাটছে না এখানকার বিশ্লেষক মহলে। এই বিস্ময়ের কারণ হলো নতুন সংবাদে সিআইএ আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলছে, যে হ্যাকিং প্রচেষ্টা তদারকি করা হয়েছে স্বয়ং ভ্লাদিমির পুতিনের দপ্তর থেকে। ভ্লাদিমির পুতিন এখন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট যার অতীত হলো তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সদস্য ছিলেন। এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় হস্তক্ষেপ বলে মানতে শুরু করেছেন অনেক শীর্ষ রাজনীতিবিদ। সেটা আর শুধু ডেমোক্রাট দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, শীর্ষ রিপাবলিকান রাজনীতিবিদদের অন্তত ৪ জন এটাকে মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি বলেই মানছেন।

সিনেটে মেজরিটি দল (রিপাবলিকান) নেতা মিচ ম্যার্কানাল ২ দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেই বলেছেন, রাশিয়া আমাদের বন্ধু নয়। তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেটা আমলে নিয়ে আমরা বাই পার্টিজান (দল নিরপেক্ষ) তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। একই বক্তব্য, সাবেক প্রেসিডেন্সিয়াল প্রার্থী, অ্যারিজোনা সিনেটর জন ম্যাককেইনের। তিনি এই প্রসঙ্গেই শুধু বলেননি, কথা বলেছেন ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাকে নিয়েও। সে রাশিয়ার বন্ধু, সে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয় কিভাবে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন মার্কও রুবিও। আর সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলছেন, ওরা তার ইমেইল ও হ্যাক করেছে, শুধুমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য!

এমনকি রিপাবলিকান দলের প্রচার মাধ্যম ফক্স নিউজ স্বীকার করছে, তারা নিশ্চিত যে গত জুন মাসে প্রথম রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী বিষয়াবলী হ্যাক করতে শুরু করে, যেটা অর্থায়ন করেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দপ্তর বা সরকারি প্রতিষ্ঠান। যদিও রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এসব আলোচনাকে বোকাদের আলোচনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর সিবিএস নিউজের সিনিয়র উপস্থাপক চার্লি রোজ জানাচ্ছেন নির্বাচন নিয়ে রাশিয়া যেটা করেছে সেটা রাজনৈতিক ৯/১১ এর সামিল। কিন্তু নতুন প্রেসিডেন্ট সেটা বিশ্বাস বা মানতে চাইছেন না, এটা বিস্ময়কর!

এখন কি করা উচিৎ, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিৎ? প্রশ্ন কর্তার এমন প্রশ্নে চার্লি রোজ বলছেন, সেটা না হলেও আলোচনা শুরু করা উচিৎ। প্রশ্ন কর্তার পাল্টা প্রশ্ন, যেই রাষ্ট্র আপনার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে তাকে কি বিশ্বাস করে আলোচনায় কোনো ফল আসবে? চার্লি’র উত্তর, অবশ্যই আমাদের রোনাল্ড রিগানের থিউরি মানতে হবে। টক বাট ভেরিফাই, অর্থাৎ কথা বলো তবে তা ভালোভাবে জেনে বুঝে নাও।

সেই কথা বলা শুরু হয়েছে দুদিক দিয়ে। একটি বিদায়ী প্রশাসনের প্রধান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অন্যটি ট্রাম্প প্রশাসনের নানা উদ্যোগ। ওবামা এনপিআর-এর সঙ্গে বলেছিলেন, পুতিন আমার মনোভাব জানেন ভালো করে; কেননা, আমি হ্যাক বিষয়ে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছিলাম। অন্য আলাপে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই টেলিফোন করে ট্রাম্পের সাথে কথা বলেছেন।

ট্রাম্পের সাথে পুতিনের ভালো সম্পর্ক যে তৈরি হবে সেটা পরিষ্কার হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনে শীর্ষমন্ত্রী সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে তেল ব্যবসায়ী আর রাশিয়ার পরিক্ষিত বন্ধু হিসেবে নিয়োগ পাওয়া রেক্স তিলারসনের নাম সামনে আসায়। তিলারসন, রাশিয়ায় পড়াশোনা করা একজন মানুষ এবং তিনি রাশিয়ার উপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ার পক্ষে। ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে আলাদা করার পর যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটা ব্যবসার স্বার্থেই তুলে নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তেল ব্যবসায়ী রেক্স তিলারসন। ট্রাম্প প্রশাসনের নিয়োগকৃত সেক্রেটারি অফ স্টেট রেক্স তিলারসন রাশিয়াতে পড়াশুনা করা একজন মানুষ, এবং তিনি এক্সন মবিলের সিইও থাকার সময় রাশিয়ার উপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছিলেন।

এখন এই সব আলোচনায় আবারো পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে ফোবার্সের তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে তার পছন্দের ব্যক্তি উঠে আসায় এখন তিনি আবারো বিশ্বে রাশিয়ার আগেরকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সুযোগ পাবেন বলেই বিশ্লেষণ বলছে। এবং সেটা করে দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যথেষ্ট ভূমিকা রাখবেন বলেই আশঙ্কা জোর হচ্ছে, সচেতন মহলে। বিশ্লেষণগুলো বলছে, অচিন্তনীয় জয় পেয়ে ট্রাম্প ঘোরের মধ্যেই আছেন, যেটা কেটে গেলেই বুঝবেন, কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গৌরব।



মন্তব্য চালু নেই