সত্যিই ভূমিকম্পের আলামত, নাকি শুধুই মিথ (দেখুন ছবিতে)

পাখি নাকি ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝতে পারে। তাই ঝড়ের আগ দিয়েই তারা অন্য স্থানে পাড়ি জমায়। প্রায় একই রকম ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় রয়েছে ব্যাঙ, পিপড়া ও আরো কয়েকটি প্রাণীর। বন্যা কিংবা এ জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস আগেই বুঝতে পেরে তারা নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে।

সুনামি, ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরাও পূর্বাভাস দিতে পারেন। তবে ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায় না। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হটাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেণ্ড থেকে এক/দু-মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে কম্পন এত দুর্বল হয়, তা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে।

বিজ্ঞানীদের মতে, ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া অসম্ভব। এটি ভূ-অভ্যন্তরে ঘটে। ফলে পর্যবেক্ষণ সম্ভব হয় না এবং পূর্বাভাসও দেওয়া যায় না। ফলে প্রায়ই দেখা যায়, মাঝারি কিংবা বড় ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। যেহেতু ঠিক কখন ভূমিকম্প ঘটবে তা বলা যায় না, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে আগে থেকেই নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

ear

বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) চিলিতে ভূমিকম্পের পর আতঙ্কিত একটি পরিবার

এমন এক ভূমিকম্প বুধবার আঘাত হেনেছে লাতিন আমেরিকার দেশ চিলিতে। ভূমিকম্পটি বেশ বড় ছিল। ৮.৩ মাত্রার। বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় আঘাত হানে ভূমিকম্পটি। এই ভূমিকম্পের পর দেশটিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ৬.২ থেকে ৬.৬ পর্যন্ত আরো কয়েকটি ছোটখাট ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। এগুলো ছিল ‘আফটার শক’। বুধবারের ভূমিকম্পে দেশটিতে এখনো পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দেশটিতে ২০১০ সালে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫ শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এ বছরের ২৫ এপ্রিল নেপালে ভয়াবহ ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৯ হাজারের বেশি লোক নিহত হন। আহত হন ২৩ হাজারের বেশি মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বহু এলাকা।

eart

গত ২৫ এপ্রিল নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপের একটি দৃশ্য

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত ভূমিকম্পে বহু প্রতিষ্ঠিত, সুসজ্জিত নগরী ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেক নগরী মাটির নিচে চলে গেছে। ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে মারা গেছে লাখ লাখ মানুষ। তারপরও আজো পর্যন্ত ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

স্বভাবতই চিলিতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে পারেননি বিজ্ঞানীর। চিলিতে যে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটতে যাচ্ছে, তা আগেই অনুমান করেছিলেন দেশটির কিছু মানুষ। ভূমিকম্পের কিছু নিদর্শন তাদের সামনে এসেছিল।

earth

চিলির পেনাস উপসাগরের সৈকতে পড়ে আছে তিমির মরদেহ

মিথ (পুরাণ) বলা আছে, যখন খুব বেশি সংখ্যক সামুদ্রিক প্রাণী এক সঙ্গে সৈকতে উঠে মারা যায় কিংবা তাদের মরদেহ সৈকতে ভেসে আসে, এটি এই অর্থই বহন করে যে, দেশটিতে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটতে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রায় ২০টি ‘সেই তিমি’ (এক ধরনের বিরল তিমি মাছ) চিলির সমুদ্র সৈকতে এসে মারা যায়। ঘটনাটি এ বছরের ২১ এপ্রিলের। দেশটির পেনাস উপসাগরের সৈকতে একসঙ্গে ২০টি সেই তিমির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেই তিমি শিকার আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। এটি একটি দুর্লভ প্রজাতির তিমি।

এ ঘটনার পর অনেকে অনুমান করেছিলেন, চিলিতে আঘাত হানতে যাচ্ছে বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প। লাইট অব মেরি নামের একটি ধর্মীয় সংগঠন বলে, ‘চিলির জন্য আপনারা সবাই দোয়া করুন। এটি ভুগতে যাচ্ছে। চিলিতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসছে। এটি কেঁপে উঠবে। সময় হলেই দেখতে পাবেন।’

earth1

গতকাল বুধবার ভূমিকম্পে লাইট অব মেরির সেই পূর্বাভাসই সত্যি হলো।

শুধুই যে চিলিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা নয়। এর আগে জাপানেও প্রায় একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে।

জাপানের হোকোটা সৈকতে উঠে আসা ডলফিন। এসব ডলফিনের মধ্যে ১৫০টি মারা যায়

এ বছরেরই ১০ এপ্রিল জাপানের হোকোটা সৈকতে বহু ডলফিন উঠে পড়ে। এদের মধ্যে ১৫০টি ডলফিন মারা যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জীবিত ডলফিনগুলোকে ফের সমুদ্রে ছেড়ে দেন। অনেকের মতে, এই ডলফিনের সমুদ্রে উঠে আসা এবং ১৫০ ডলফিনের মৃত্যু জাপানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আলামত এবং কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে এ বছরই এ দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

তাদের মতে, ২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের টোহুকুতে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের আগে এ ধরনের ঘটনাই ঘটেছিল। সেবারও বহু মাছের মরদেহ সৈকতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই ঘটনার কয়েক মাস পরেই ওই ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশটিতে সুনামি হয় এবং এতে প্রায় ১৫,৮৯৩ জন নিহত হন। হাজার হাজার লোক আহত হন। প্রায় দেড় লাখ ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় এবং আড়াই লাখের মতো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

earth2

জাপানের হোকোটা সৈকতে মরে পড়ে থাকা কয়েকটি ডলফিন দেখছে তিন শিশু

এসব ঘটনার পর বিজ্ঞানীরা খতিয়ে দেখছেন, ভূমিকম্পের সঙ্গে আসলেই সামুদ্রিক প্রাণীর ডাঙায় উঠে মারা যাওয়ার কোনো যোগসূত্র আছে কি না। হতে পারে, ভূমিকম্পের কিছু দিন আগে ভূ-গর্ভস্ত প্লেটের অস্বাভাবিক নড়াচড়ায় সমুদ্রের তলদেশে কোনো কম্পন সৃষ্টি হয়। আর সামুদ্রিক প্রাণীরা তা টের পেয়ে ভয়ে সৈকতে উঠে পড়ে এবং সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে না পেরে মারা যায়।

সামুদ্রিক প্রাণীদের এরূপ সৈকতে এসে মারা যাওয়ার ঘটনা যদি সত্যিই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হয়, তাহলে বিজ্ঞানীরা হয়তো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যাপারে ‘টানেরের শেষ প্রান্তে আলো’ দেখতে পাবেন। তবে এসব ঘটনা শুধুই মিথলোজি, নাকি সত্যিই ভূমিকম্পের আলামত, তা সময়ই বলে দেবে। চিলিতে হলো। দেখা যাক, এ বছর জাপানের ভাগ্যে কী আছে!



মন্তব্য চালু নেই