সত্যতা পাচ্ছে না ইসি

পৌরসভা নির্বাচনে অনিয়ম, প্রভাব বিস্তার, প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধামকি ও আচরণ বিধি লংঘনের শতাধিক অভিযোগ পেয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যতা খুঁজে পাচ্ছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা। এমনকি গণমাধ্যমের কোনো কোনো সংবাদকে অতিরঞ্জিত বলেও জানিয়েছেন তারা।

বুধবার নির্বাচন কমিশন সুত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। কমিশন সুত্র জানায়, দু’ চারটি অভিযোগের সত্যতা মিললেও শোকজ করে দায় সারছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। নির্বাচন কমিশন থেকে ৭০টির মতো অনিয়ম ও আচরণ বিধি লংঘনের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠানো ২৪টি তদন্ত প্রতিবেদনে এ সব তথ্য মিলেছে।

এমন পরিস্থিতিতে আচরণ বিধি লংঘনের ঘটনায় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আর কোনো চিঠি দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। তিনি বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটরা আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন (সরাসরি ব্যবস্থা) নিবে।

এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, প্রার্থী ও বিভিন্ন কোয়ার্টার থেকে অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। আমরা দ্রুত অ্যাকশন নিচ্ছি। ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে চলে গেছেন। আচরণ বিধি লংঘনের ঘটনায় তারা হাজার হাজার টাকা জরিমানা করছেন।

তিনি বলেন, বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি, কৈফিয়ত চেয়েছি। অনেকেই প্রতিবেদন কমিশনে পাঠিয়েছেন। অনেকেই জানিয়েছেন তারা অভিযোগের সত্যতা পাননি। আমরা বলেছি, অভিযোগের সত্যতা না পেলেও প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করে পাঠাবেন। ইতোমধ্যে অনেক রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রতিবেদন এসেছে। অনেক স্থানে অ্যাকশন নিয়েছে।

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনে অনিয়ম ও আচরণ বিধি লংঘন নিয়ে প্রার্থীদের দেওয়া অভিযোগ ও গণমাধ্যমের সংবাদ পর্যালোচনা করতে একটি টীম কাজ করছে। ওই টীমের কাজ হচ্ছে- প্রাপ্ত অভিযোগগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে রিটার্নিং কর্মকর্তা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তা একত্রিত করে কমিশনকে অবহিত করা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভোটগ্রহণের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে কমিশনে অভিযোগ জমা পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। এগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তারা আরও জানান, প্রতিদিন হামলা-সংঘর্ষ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের সংবাদ আসছে গণমাধ্যমে।

এসব খবর প্রকাশের পেপার কাটিং করে, অভিযোগ ফাইল করে কমিশনের অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ৩-৪দিন পার হয়ে যাচ্ছে। চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন। এতে অনেক সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ফলে বেশিরভাগ ঘটনার পর দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাওয়ায় সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের কারণ ব্যাখ্যা করতে চিঠি দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এ তালিকায় এমপিরাও রয়েছেন।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, ঝিনাইদহের মহেশপুরে বিএনপির প্রার্থী মো. নজিব উদ দৌলা ষড়যন্ত্র করে প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, মনোনয়নপত্র থেকে হলফনামা সরিয়ে ভুল তথ্য সংযোজন করে প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। পত্রিকার সংবাদ বিশ্লেষণ করে ওই অভিযোগ তদন্ত করতে রিটার্নিংক কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয় কমিশন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাননি বলে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন ওই পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।

এতে রিটার্নিং কর্মকর্তা উল্লেখ করে করেছেন, ওই প্রার্থী হলফনামায় নোটারি পাবলিক করেননি। এমনকি তিনি নিজেও স্বাক্ষর করেননি। যদিও পরবর্তীতে মো. নজিব উদ দৌলা উচ্চ আদালতে রায় নিয়ে প্রার্থিতা করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রিটার্নিং কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, অসম্পূর্ণ মনোনয়নপত্র দাখিল করায় তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। আপিলেও বাতিলের আদেশ বহাল ছিল।

এছাড়া কমিশনে যেসব তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ময়মনসিংহের ফুলপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রচারে দুই মন্ত্রীর অংশ নিয়ে আচরণ লংঘনের অভিযোগ। এ ঘটনায় ওই পৌরসভার সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তা তদন্ত করে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আচরণ বিধি লংঘনের ঘটনার কোনো সত্যতা পাননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রশাসনকে না জানিয়ে গভীর রাতে আনির্ধারিত সভাটি হচ্ছিল। ওই পথে দুই মন্ত্রী মহোদয় পৃথক সময়ে যাওয়ার সময়ে স্থানীয় কতিপয় অতি উৎসাহী লোকজন তাদেরকে অনেকটা জোর করে মিটিংয়ে নিয়ে আসেন। তারা মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন তবে নির্বাচন নিয়ে কিছু বলেন নি। মন্ত্রী মহোদয়দের একের সঙ্গে অপরের দেখাও হয়নি বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে দুই মন্ত্রীর আচরণ বিধি লংঘনের অভিযোগের সত্যতা না পেলেও ওই প্রচার সভার জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে দায়ি করে শোকজ করা হয়।

নোয়াখালীর চাঁটখিলে বিএনপির প্রার্থী মোস্তফা কামালকে জোর করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বাধ্য করার ঘটনায় কমিশন থেকেই তদন্ত করা হলেও ওই ঘটনার সত্যতা পাননি তদন্ত কমিটি। ওই অভিযোগে বলা হয়েছিল, গত ১৩ ডিসেম্বর বিএনপির প্রার্থীকে সরকার দলীয় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা জোরপূর্বক মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য স্বাক্ষর নিয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা ওই প্রার্থীর প্রত্যাহারের আবেদনপত্র রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেন। তবে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটির সামনে প্রার্থী ও অভিযোগকারী উপস্থিত ছিলেন না।

তবে বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন অভিযোগ করেছেন, তদন্ত কমিটির শুনানিতে অংশ নিতে প্রার্থীকে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। এছাড়া চাটখিলে তদন্ত করা হয়েছে। ওই তদন্তের সময়ে প্রার্থীর উপস্থিতি তার জীবনের জন্য ঝুঁকি ছিল।

একই ধরনের প্রতিবেদন এসেছে চাঁদপুরের মতলবের ছেংগারচর পৌরসভা থেকে। অভিযোগে বলা হয়েছিল, বিএনপি প্রার্থীর প্রার্থিতা সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বাতিল করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদন ওই অভিযোগ অস্বীকার করে বলা হয়েছে, অসম্পূর্ণ মনোনয়নপত্র দাখিল করায় তা বাতিল করা হয়। ইসি সচিবালয়ের উর্দ্ধতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের চিঠি দেওয়ায় তারা চাপের মধ্যে পড়ে যান। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আচরণ বিধি প্রতিপালনের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ইসি থেকে যেসব অভিযোগের তদন্তের জন্য পাঠানো হয়, তার সত্যতা স্বীকার করা হলে প্রকারান্তরে মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি উঠে আসে। নিজেদের বাঁচাতেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের সত্যতা নেই বলছেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তবে দু’ একটি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই