সঠিক মননে প্রজন্ম গড়ে তোলার বিকল্প নেই

জঙ্গিবাদ আমাদের জীবনকে করে তুলেছে আতঙ্কিত। চলাচল, আনন্দ উৎসবকে করেছে সংকুচিত। মানুষের মনে সারাক্ষণ একটি আতঙ্ক। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলেছি আমরা। এই বিচারে, জঙ্গিরা অনেক অর্থেই সফল হয়েছে; কারণ তারা আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল- আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমরা ভয় পেয়েছি। কিন্তু এটা কি হতে দেয়া যায়? আমরা কি এসব দুস্কৃতিকারীদের সফল হতে দিতে পারি? তবে আমাদের করণীয় কি? আজ বাংলাদেশ, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরাক, জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশ জঙ্গিবাদের নির্মম শিকার। সুতরাং এখন সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার। প্রত্যেক মানুষকে নিজ নিজ জায়গা থেকে চিন্তা করে নিজ কর্তব্য কর্মটি নির্ধারণ করতে হবে। আমরা যুথবদ্ধ প্রতিরোধ করবো, এটি আমাদের করতেই হবে। অনেকের বাস্তবতায় হয়তো সেই যুথবদ্ধ আন্দোলনের সমর্থন করা সম্ভব হলেও আন্দোলনে উপস্থিত থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব না। তাই যে যেখানেই আছি নিজের অবস্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সচেতন হতে হবে যেমন নিজের নিরাপত্তা বিষয়ে, তেমনি আশে পাশের মানুষের বিষয়েও। চোখ, কান, বিবেক, বুদ্ধি সদা জাগ্রত রাখা এখন প্রত্যেকের কর্তব্য।

আমি পেশায় একজন শিক্ষক। আমরা প্রায়শই বলে থাকি, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। প্রকৃতপক্ষে আমরা কজন মানুষ গড়ার কথা আদৌ ভাবছি? শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যসূচির বাইরে কোন বিষয়েই আলোচনা করি না। বড় উদাসীন আমরা চারপাশের ঘটনাবলি সম্পর্কে। মনে রাখি না পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করানোই শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়। শিক্ষকরা যদি একটু সচেতন হই, শিক্ষার্থীদের প্রথম দ্বিতীয় হবার বা জিপিএ ৫ এর ইঁদুর দৌড়ের ট্র্যাক এ তুলে না দিয়ে প্রকৃত মানুষ হবার জন্যে অনুপ্রাণিত করি, তবেই শিক্ষক জীবন সার্থক। সমাজটাও তবে পাবে সুনাগরিক। এই অস্থির সময়ে সঠিক মননে প্রজন্ম গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এত রমরমা যখন ছিল না কিংবা এতো সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, দেশি বিদেশি প্রজেক্ট যখন ছিল না তখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানাভাবে শিক্ষার্থীদের মেধা মননের বিকাশে নানা ধরণের কাজ করতো। প্রতিটি শিক্ষায়তনে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, প্রতিযোগিতা নিয়মিত হতো। আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। আমরা মনে করতে পারি কি ‘নির্মান ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’-এর বিপুল জনপ্রিয়তার কথা। যার ফসল হিসাবে পেয়েছি খালেদ মাহমুদ সুজনের মত আরও অনেক ক্রিকেটারকে। ‘বাটা দাবা প্রতিযোগিতা’ থেকে পেয়েছি রিফাত বিন সাত্তার সহ দুজন গ্র্যান্ড মাস্টারকে।

সিটি কর্পোরেশন ৮০ র দশকেও আন্তঃস্কুল সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতো প্রতি বছর। এতে আগ্রহী হবার ফলে অসামাজিক কাজে মনোনিবেশ করার সুযোগই ছিলো না শিক্ষার্থীদের। পরিষ্কার মনের সুস্থ মানসিকতার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এসব পদক্ষেপ খুব জরুরি। এখন বাংলাদেশে নয়টি সিটি কর্পোরেশন। এই নয়টি সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন স্কুল কলেজগুলির মধ্যে যদি আন্তঃস্কুল বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন করার ব্যবস্থা করা যায়, তবে প্রজন্মের মনন ও আদর্শিক গঠনে যথেষ্ট সদর্থক প্রভাব রাখবে।

আশি নব্বইয়ের দশকের তুলনায় এ সময় বিশাল প্রতিষ্ঠান, মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি অনেক বেশি। তারা বিভিন্নভাবে অর্থ খরচও করে অনেক বেশি। যেমন নানান বিজ্ঞাপন, উত্তাল কনসার্ট, রিয়েলিটি শো, সুন্দরী প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এসব আয়োজন কি তরুণ প্রজন্মকে অস্থির আর নিজস্ব সংস্কৃতিবিমুখ এবং অনেক ক্ষেত্রে ড্রাগের দিকে টেনে নিচ্ছে না? কেন এসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান অথবা দেশীয় বড় বড় প্রতিষ্ঠান ‘বাটা দাবা টুর্নামেন্ট’ বা ‘নির্মান ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’- এর মত কিশোর-তরুণদের আকৃষ্ট করার মত খেলাধূলায় আগ্রহী করার মতো আয়োজন করেন না? বিশ্বের এই অস্থির পরিবেশে এ ধরণের উদ্যোগ প্রজন্মের বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।

আজকের বাবা মায়েরা সন্তানকে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক ও কোচিংমুখী করতে চান। তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ও সৃজনশীল কাজে, সহপাঠ কার্যক্রমে আগ্রহী করে তোলা জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোরম পরিবেশে সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার থাকা আবশ্যক। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সেখানে গিয়ে বই পড়তে বাধ্য করতে হবে। শহরের তথাকথিক নামকরা স্কুল হিসেবে ক্যাত স্কুলগুলোতেই গ্রন্থাগারের বেহাল দশা। এসব দিকে আর কবে মনোযোগি হব আমরা?

প্রত্যেক শিক্ষায়তনে বিতর্ক ক্লাব, পরিবেশ ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাবের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি ক্লাব এবং সংলগ্ন ছোট একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পাঠাগার থাকা দরকার। এতে দেশের প্রতি মায়া, দেশপ্রেম, ঐতিহ্যের প্রতি প্রজন্মের আগ্রহ তৈরি করা সম্ভব।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোর নির্বাচন সম্পন্ন করে সেগুলোকে সচল করা আবশ্যক। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠকনে দাপটের সাথে লেখা থাকে রাজনীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান। এই চিন্তা বিশ্বাস বাতিল করে লিখতে হবে একটি জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার এসব ভাবনাকে জাগ্রত রাখতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম চালু থাকলে সংস্কৃতি ও মেধাভিত্তিক কর্মকাণ্ড চলবে। তখন বক্তৃতা দিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা বারবার বলতে হবে না, এটা তৈরি হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিজস্ব উদ্যোগে।

টিএসসিগুলোতে অবাধ সাংস্কৃতিক চর্চা করতে উৎসাহিত করতে হবে শিক্ষার্থীদের। বিভিন্ন সেমিনার, ডেমোনেস্ট্রেশন, পথনাটক, সঙ্গীত অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে। ছাত্র-শিক্ষক আন্তঃসম্পর্ক বাড়াতে হবে, যাতে যে কোন সমস্যা ছাত্র নির্দ্বিধায় শিক্ষককে জানাতে পারে। শিক্ষককেও ধৈর্য্যের সাথে শুনে সঠিক পরামর্শ দেন।

বর্তমানে জঙ্গিসন্ত্রাস তৈরিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এটি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্বিক চিত্র নয়, তা প্রমাণের দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান সমূহেরই। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে কোন লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না বরং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সে কথা মনে রেখে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশপ্রেমী আদর্শ মানুষ তৈরি করতে হবে। আজকের এই বিপদ কেবল বাংলাদেশের নয়- সারা পৃথিবীর। এই বিপদে সারা পৃথিবীর শুভবোধসম্পন্ন মানুষকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও সংস্কৃতি কর্মী



মন্তব্য চালু নেই