ঝুঁকির মধ্যে শহর রক্ষা বাঁধ

সঠিকভাবে কাজ না করার অভিযোগ ভোলায় মেঘনার ভাঙন

মেঘনা নদীর ভাঙন তীব্রতা আরো বেড়েছে। ভোলায় গত কয়েক দিনের কিছুটা বৃষ্টি থামলেও থামেনি মেঘনার ভাঙন। বরং প্রায় প্রতিদিনই ভাঙছে সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। গৃহহারা হচ্ছে বহু পরিবার। ভাঙনে সর্বশান্ত হয়ে এসব পরিবার এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নদী ভাঙনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের গাফিলতিকেও দায়ী করছেন স্থানীয়রা।

এদিকে, ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ত্রাণ পাননি বলেও অভিযোগ করেছেন।

ভোলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের মেঘনার পাড়ে সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা জানান, মেঘনা নদীর ভাঙনে মাত্র ২ সপ্তাহে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার এলাকা, ওই এলাকার সহ¯্রাধিক ঘর-বাড়ি, ৩টি মসজিদ, ৫টি মক্তব, ২টি বোট, পুলিশ ফাঁড়ি, ইসলামী মিশন, ৩শ’ একর ফসলি জমি, ২ শতাধিক দোকান এবং ১ জন মাঝিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভেসে গেছে দুই শতাধিক পুকুর ও শতাধিক ঘেরের মাছ। ভেসে গেছে অন্তত শতাধিক গবাদি পশু। এতে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তারা।

ইলিশা ইউনিয়নের কালুপুর গ্রামের বাসিন্দা হানিফ (৭৪) বলেন, ‘আমি বিগত ৫০ বছরেও এমন ভাঙন দেখিনি। মেঘনার তীরেই আমার বাড়ি ছিল। ছিল এক কানি ৯ গন্ডা জমি। যেই জমির লগ্নি করা হতো বছরে ৮০ হাজার টাকা। সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত আমি ৫বার মেঘনা নদীর ভাঙনের শিকার হয়েছি। এখন আর কিচ্ছু নাই। খালি জীবনটা আছে কোন রকমে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে আজ নদী বেশি ভাঙছে। কারণ গত প্রায় দেড় মাস আগে যখন নদী ভাঙন শুরু হয় তখন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নির্দেশে পাউবো কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারের মাধ্যমে ভাঙন রোধে কিছু দিন ইলিশা কালুপুর এলাকা দিয়ে মেঘনার পাড়ে জিইও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করে। তবে ১৫ দিন পর হঠাৎ করে পাউবো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে ঠিকাদার সেখানে জিইও ব্যাগ ফেলা বন্ধ করে দেন। তখন থেকেই ভাঙনের তীব্রতা দেখা দেয়।’

হানিফ খলিফা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা যদি মাঝ পথে জিইও ব্যাগ ফেলা বন্ধ না করে আরো কিছু জিইও ব্যাগ ফেলতো তাহলে হয়তো ভাঙন রোধ হতো।’

একই গ্রামের বাসিন্দা শামছুদ্দিন (৪৫) বলেন, ‘মেঘনার ভাঙন যেন থামছেই না। মেঘনা নদীর ভাঙনে আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। আমার বাড়িঘরসহ সব তো নদীগর্ভে বিলীন হইছেই। এ ছাড়া ২৭ জেলেকে আমি নগদ ৪ লাখ ৪১ হাজার টাকা দাদন দিয়েছিলাম। সেই সব জেলেদের বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় তারা এখন লাপাত্তা। ওই টাকা আর পাওয়া যাবে কিনা-তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

শামসুদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমাদেরকে সরকারিভাবে কোন ত্রাণ বা সাহায্য দেয়া হয়নি।’ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে কোন ত্রাণ দেয়া হয়নি। অথচ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তাদেরকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

মোঃ আলাউদ্দিন (৭৪) নামে অপর একজন বলেন, ‘গত প্রায় দেড় মাসে নদী ভাঙনে বহু মানুষ গৃহহারা হলেও গত ২ দিন ধরে নদীর ¯্রােত কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তাই ভাঙন রোধে এখনই নদীর তীরে জিইও ব্যাগ এবং ব্লক ফেলার দাবি জানান তিনি।

ইলিশা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা হযরত আলী চৌকিদার (৫৫) বলেন, গত ২০ বছর যাবত এই খানে বসবাস করছি। কিন্তু বিগত বছরে এমন ভাঙন দেখিনি। নদী ভাঙনের কারণে তাকে এ পর্যন্ত ২/৩ বার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন সঠিকভাবে নদী ভাঙন রোধে কাজ করছেন না। তারা কোন রকম দায় এড়ানোর কাজ করছে।

তিনি আরো বলেন, গত ৩ দিনে কমপক্ষে ২ কিলোমিটার এলাকা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি এই নদীর গর্ভে ২টি বোট এবং জাহাঙ্গীর (৩৬) নামের একজন মাঝি হারিয়ে গেছে। ওই ২টি বোট এবং মাঝিকে এখনও খুজে পাওয়া যায়নি।

বোট আর মাঝি সম্পর্কে তিনি বলেন, নদীর মাঝ খান দিয়ে ২টি বোট যাচ্ছিল; তখন হঠাৎ বোট দুটি নদীর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। আর জাহাঙ্গীর নামের মাঝি নদীর কিনারে নৌকায় বসে মাছ ধরার জাল কাটছিলেন, এমন সময় উপর থেকে বড় একটি মাটির স্তুপ তার উপর পরে। তখন সে নদীতে তলিয়ে যায়। তবে নদী ভাঙনের শিকার শর্বসান্ত এলাকায় যৎ সামান্য সাহায্য দেয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হেকিম বলেন, ‘মেঘনার ভাঙন থামেনি। বরং ভাঙনের তীব্রতা আরো বেড়েছে।’ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ভাঙন রোধে পাউবো ও ঠিকাদার অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। এখনও মেঘনার তীরে টিউব ফেলা হচ্ছে।’ এ পর্যন্ত ৪১টি টিউব ফেলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।



মন্তব্য চালু নেই