সংবিধান লঙ্ঘন করেও মন্ত্রী তারা

মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়ে কেউ কোম্পানির পরিচালক পদে থাকতে পারেন না। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সাংবিধানিক পদের ক্ষেত্রে কোম্পানির পরিচালক পদটিকে লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ পদটির সঙ্গে কিছু আর্থিক সুবিধা জড়িত থাকে। অথচ তিন মন্ত্রী ও দুই প্রতিমন্ত্রী সংবিধান লংঘন করেই চলেছেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ।

সংবিধান লঙ্ঘন করেও মন্ত্রী তাঁরা

নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদে থেকে ‘সংবিধান লঙ্ঘন’ করে চলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল)। অভিযোগ ওঠার পরও বহাল তবিয়তে আছেন স্বপদে।

তার মতো এমন আরও চারজন সদস্য আছেন মন্ত্রিসভায়। তারা হলেন- গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এই চারজন অবশ্য সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে এরই মধ্যে আইনি নোটিশ পেয়েছেন। অথচ পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে এখনো কোনো আইনি নোটিশ পাঠানো হয়নি।

গত ৯ এপ্রিল সাপ্তাহিক এই সময়-এর ১৫তম সংখ্যায় ‘মন্ত্রী হওয়ার পরও লাভজনক পদে লোটাস কামাল’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল পরিকল্পনামন্ত্রীর ব্যাপারে। কিন্তু তারপর দীর্ঘ সাত মাস পার হলেও মুস্তফা কামাল একাধারে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লোটাস কামাল গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও পদে আছেন।

এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লোটাস কামাল গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রী ওই প্রতিষ্ঠানেরও একজন পরিচালক। এছাড়া বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অরবিটালস এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা অংশীদার তিনি। তার পরিবারের সদস্যরাও আছেন এই প্রতিষ্ঠানের একই পদে। লোটাস কামাল গ্রুপের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট এবং প্রতিষ্ঠানের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর পদকে সংবিধান লাভজনক পদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ ধারায় এ বিষয়ে বলা আছে, ‘এই অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হয়, এরূপ কোনো পদে নিযুক্ত বা কর্মরত ব্যক্তি কোনো লাভজনক পদ কিংবা বেতনাদিযুক্ত পদ বা মর্যাদায় বহাল হইবেন না কিংবা মুনাফালাভের উদ্দেশ্যযুক্ত কোনো কোম্পানি, সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় বা পরিচালনায় কোনোরূপ অংশগ্রহণ করিবেন না।’

মন্ত্রী ছাড়াও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, নির্বাচন কমিশনার ও সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যের বেলায়ও সংবিধানের এ ধারা প্রযোজ্য।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী রফিক-উল হক বলেন, ‘মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়ে সংবিধান রক্ষার যে শপথ তারা নিয়েছিলেন তা পালন করছেন না। বরং লঙ্ঘন করছেন। এ কারণে তারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পদের জন্য অযোগ্য হয়ে যেতে পারেন।’

সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়ে কেউ কোম্পাানির পরিচালক পদে থাকতে পারেন না। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সাংবিধানিক পদের ক্ষেত্রে কোম্পানির পরিচালক পদটিকে লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ পদটির সঙ্গে কিছু আর্থিক সুবিধা জড়িত থাকে।

তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের কোম্পানি আইন অনুযায়ী একজন শেয়ারধারী যখন পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন সেটিকে লাভজনক পদ হিসেবে গণ্য করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে একজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেলায় কোম্পানির পরিচালক পদ লাভজনক হিসেবে বিবেচনায় ধরা হয়। কারণ পরিচালনা পর্ষদের সভায় অংশ নিলে পরিচালকদের সম্মানী দেওয়া হয়।

আ হ ম মুস্তফা কামাল

এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, পরিচালকদের তালিকায় মুস্তফা কামালের নাম রয়েছে। এছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত লোটাস কামাল গ্রুপের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও মুস্তফা কামাল লোটাস কামাল গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে তার নাম রয়েছে। সাইটে ঢুকলেই দেখা যায় লোটাস কামাল প্রুপের লোগো এবং তার ছবি।

এর আগে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি কারণ দর্শাও নোটিশের জবাব দিয়ে লেখা অরবিটাল এন্টারপ্রাইজের একটি চিঠিতে সই করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি জমা দেওয়া ওই চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা অংশীদার হিসেবে তার নাম উল্লেখ ছিল। অথচ ওই তারিখে তিনি সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী।

মোশাররফ হোসেন

সেবা খাতের চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য পেনিনসুলা চিটাগাং গত জুনে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। চলতি বছরের ৩০ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে আইপিও অর্থ সংগ্রহ করে। আইপিও প্রসপেক্টাস বা বিবরণীপত্রে চেয়ারম্যান হিসেবে মোশাররফ হোসেনের নাম আছে।

মন্ত্রী হিসেবে মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব নিয়েছেন চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি। আর তার মালিকানাধীন কো¤পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলেছেন মার্চ-এপ্রিলে। অর্থাৎ মন্ত্রী পদে বহাল হওয়ার পরও তিনি পেনিনসুলার পরিচালক রয়েছেন।

সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, আইপিও প্রসপেক্টাস আইনগত দলিল বা লিগ্যাল ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই প্রসপেক্টাসে কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হলে তা সরাসরি সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ

বস্ত্র খাতের কোম্পানি শাশা ডেনিমসের পরিচালক পদে আছেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। ১৪ অক্টোবর বিএসইসির সভায় আইপিওর অনুমোদন পায় প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা ডিইপিজেডে এই প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। আগে তিনি কোম্পানিটির চেয়ারম্যান থাকলেও সম্প্রতি সেই দায়িত্ব স্ত্রী পারভীন মাহমুদের কাছে হস্তান্তরের আবেদন করেছেন। কোম্পানির পরিচালক পদে এখনো বহাল রয়েছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠান এনার্জিস পাওয়ার করপোরেশন তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।

জাহিদ মালেক

আইডিআরএর কাছে সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের পরিচালকদের একজন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এমনকি আরজেএসসির হালনাগাদ তথ্য ও কোম্পানির ওয়েবসাইটে পরিচালক হিসেবে তার নাম আছে।

গত ২৮ অক্টোবর সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পরিচালক হিসেবে জাহিদ মালেকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর পরিচয়টিও উল্লেখ রয়েছে।

সেখানে আরও বলা হয়েছে, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন। কোম্পানির পক্ষ থেকে বিএসইসিতে জমা দেওয়া সর্বশেষ শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, পরিচালক জাহিদ মালেকের হাতে সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের প্রায় সোয়া ৯ শতাংশ শেয়ার আছে।

তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম তার উদ্যোক্তা-পরিচালকদের গত সেপ্টেম্বরের শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত যে তথ্য বিএসইসিতে জমা দিয়েছে, তাতেও উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে নাম রয়েছে প্রতিমন্ত্রীর। ওই কোম্পানির প্রায় ৫৬ লাখ শেয়ার রয়েছে তার হাতে। বিডি থাই অ্যালুমিনিয়ামের কোম্পানি সচিব জাহিদুল আলম স্বাক্ষরিত শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত চিঠি ২ অক্টোবর বিএসইসিতে জমা দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে জাহিদ মালেক বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর আমার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, কোম্পানির পরিচালক পদে থাকতে কোনো আইনি বাধা নেই। তাই চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে পরিচালক হিসেবে আছি। তাছাড়া পারিবারিকভাবেই আমি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এখান থেকে চাইলেই ছেড়ে আসা সম্ভব নয়।’ তবে তিনি প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর কোম্পানির সরাসরি কোনো কাজে যুক্ত নন বলে জানান ।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী

আরামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে আছেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরও লাভজনক পদ থেকে সরে আসেননি তিনি।

এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আরামিট সিমেন্ট ২ অক্টোবর উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত সর্বশেষ যে তালিকা বিএসইসিতে জমা দিয়েছে, তাতে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নাম রয়েছে। ৫০ লাখের বেশি শেয়ার নিয়ে তিনি এ পদে রয়েছেন। এ ছাড়া আরামিট ফুটওয়্যার নামের অপর একটি কোম্পানির পরিচালক পদেও রয়েছেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী।

পদত্যাগের দাবিতে আইনি নোটিশ

মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরও নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদে থাকার অভিযোগ ওঠার পর দুই মন্ত্রী ও দুই প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গত ৬ ও ৯ নভেম্বর আলাদা করে এসব নোটিশ পাঠানো হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্নার পক্ষে নোটিশ পাঠান আরেক আইনজীবী শাহদীন মালিক।

নোটিশে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। তা না হলে হাইকোর্টে মামলা করা হবে বলে জানানো হয়।

এ বিষয়ে শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোম্পানির পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো বিধান নেই। কিন্তু যাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে তারা বিভিন্ন লাভজনক কোম্পানির পরিচালক পদে আছেন, যা সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন। ফলে তারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েছেন। সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে



মন্তব্য চালু নেই