বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাস

জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪ পাস হয়েছে। এর ফলে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনস্থাপিত হবে বর্তমান সংবিধানে। এতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পাবে সংসদ।

তবে কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করতে হলে তার বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অসমর্থ্যের অভিযোগ বিশেষ কমিটির তদন্তে প্রমাণিত হতে হবে। আর ওই তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হবে। তারপর সংবিধানে পুনস্থাপিত হওয়া ৯৬ অনুচ্ছেদ কার্যকর করা সম্ভব হবে।

বুধবার সন্ধ্যায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর শেষে দিনের অন্যান্য কার্যসূচি স্থগিত করে বিল পাসের কার্যক্রম শুরু হয়। বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

বিলটির ওপর বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ জাতীয় পার্টি, সরকারের শরীক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বিএনএফ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যসহ মোট ১৫ জন জনমত যাচাই এবং ৩০টি সংশোধনী প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও পরে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।

পরে বিলটি পাসের জন্য উপস্থাপিত হবে কি না তা নির্ধারণ করতে সংসদের লবিতে স্থাপিত বুথে গোপন ব্যালটে বিভক্তি ভোট হয়। বিলটি উপস্থাপনের পক্ষে ভোট পড়ে ৩২৮ আর বিপক্ষে পড়ে শূন্য। আর বিলটি পাসের জন্য দ্বিতীয় দফায় বিভক্তি ভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে ৩২৭ আর ‘না’ ভোট পড়ে শূন্য।

এই বিলটি পাস হওয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনস্থাপিত হবে। ওই অনুচ্ছেদে কোনো বিচারককে তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিল। তবে এই অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বর্তমান বিধান অনুযায়ী ৬৭ বহাল রাখা হয়েছে।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগের কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারককে তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে এই পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় সুপ্রীম কোর্টের কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে কোনো বিচারককে তার পদ হতে অপসারণ করা যাবে বলে বিধান করা হয়।

ওই বিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, কোনো বিচারককে তার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাণোর যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত তাকে অপসারণ করা যাবে না। ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগে অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অপর দুইজন প্রবীণ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের মতো উচ্চ আদালতের বিচারকদের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার নীতি বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে।

আরো বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৯৬ এর দফা ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের প্রনীত সংবধিানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩ ও ৪ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদেরকে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে এই বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। উক্ত বিলের ৩ দফা অনুযায়ী কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সুতরাং ওই আইনে সুনির্দিষ্টকৃত পদ্ধতি অনুসরণে অভিযোগ প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে অপসারণের সুযোগ থাকবে না। এমতাবস্থায়, বিলটি আইনে পরিণত হইলে স্বচ্ছতা দৃশ্যমান হইবে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে বিচারকগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব অবাধ ও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পালনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত রাখতে পারবেন’।

উল্লেখ্য, গত ৭ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ওই দিনই বিলটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

যাচাই-বাছাই শেষে বিলের ওপর সংসদে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সংসদীয় কমিটি গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর মাত্র দুটি বৈঠকেই এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে।

এর আগে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে ওই সংশোধনীর মাধ্যমে। সংসদে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সেদিন বিলটি পাস হয়েছিল। বিলটির পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ২৯১টি, বিপক্ষে ‘না’ ভোট পড়েছিল মাত্র ১টি। নবম সংসদের একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য মো. ফজলুল আজিম ওই ‘না’ ভোটটি দিয়েছিলেন।

বিল বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব
সংবিধান সংশোধন বিলটি বাছাই কমিটিতে পাঠিয়ে রিপোর্ট প্রদানের জন্য প্রস্তাব করেন মোট আট জন সংসদ সদস্য। এর মধ্যে মো. রুস্তম আলী ফরাজী চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫ জন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। একই প্রস্তাব করেন স্বতন্ত্র তাহজীব আলম সিদ্দিকী, জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী ও মো. আবদুল মতিন এবং বিএনএফ’র এস এম আবুল কালাম আজাদ।

এছাড়া ৩ সদস্যের কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন জাতীয় পার্টির বেগম রওশন আরা মান্নান। আর ৬ জন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম।

বিলটি জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব
বিলটির ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়া উদ্দীন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ, মো. আবদুল মতিন, নুরুল ইসলাম মিলন, পীর ফজলুর রহমান, এম এ মান্নান, বেগম রওশন আরা মান্নান ও ইয়াহইয়া চৌধুরী, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, বিএনএফ’র এস এম আবদুল কালাম আজাদ এবং স্বতন্ত্র সদস্য মো. রুস্তব আলী ফরাজী, হাজী মো. সেলিম ও তাহজীব আলম সিদ্দিকী।

দফায় সংশোধন প্রস্তাব
সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪ সম্পর্কে স্থায়ী কমিটির রিপোর্টের ১ দফায় সংশোধনী এনেছেন মোট ৩ জন সংসদ সদস্য। এদের মধ্যে রুস্তম আলী ফরাজী বিচারপতিদের বয়স ৭০ বছর করা প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া হাজী মো. সেলিম ও এম এ হান্নান দফা ১ এর উপর সংশোধনী আনেন। দফা ২ এর উপর সংশোধনী এসেছে মোট ২৭ টি।

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজী দফা ২ এ প্রস্তাব করেন, ‘বিচারকদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের কোন প্রস্তাব সংসদে উত্থাপিত হরে সংসদের নূন্যতম ১০০ জন সদস্যের উক্ত প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন থাকলে প্রস্তাবটি সরাসরি সংসদ কর্তৃক গঠিত জাজেস ইনকোয়ারী কমিশনে প্রেরিত হবে এবং সংসদ উক্ত কমিশনের তদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে প্রমাণিত অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারপতিকে অপসারণ করা যাবে না।’

তিনি দফা (২) এর প্রস্তাবিত উপ-দফা (৪) এর পর নতুন উপ-দফা (৫) সন্নিবেশের প্রস্তাব করেন। রুস্তম আলী ফরাজী তার প্রস্তাবিত ৫ উপ-দফায় বলেন, ‘এই আইনটি কার্যকর হবার পর অনতিবিলম্বে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগের নীতিমালা তৈরী করা লক্ষ্যে ‘বিচারক নিয়োগ কমিশন’ গঠন করিবেন।’

এছাড়া সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, টিপু সুলতান, শেখ হাফিজুর রহমান, ইয়াসিন আলী, নাজমুল হক প্রধান এবং শিরীন আখতার বিলের ২ দফায় প্রস্তাবিত উপ-দফা (৩) এর তৃতীয় পঙক্তিতে অবস্থিত ‘নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন’ শব্দাবলীর পরে ‘এবং একই সঙ্গে সংসদ বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করিতে পারিবেন’ শব্দাবলী সন্নিবেশের প্রস্তাব করেন।

বিলের উপর আলোচনায় সংসদ সদস্যরা যা বলেন
স্বতন্ত্র সাংসদ হাজী সেলিম সংবিধান সংশোধন বিলটি পাসের আগে বিলটির ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন। এছাড়া বিএনএফ এর সাংসদ আবুল কালাম আজাদ বিলটির সমর্থন করলেও একই সঙ্গে বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই এর প্র্রস্তাব দেন। জাতীয় পার্টির ইয়াহিয়া চৌধুরী তড়িঘড়ি করে বিলটি পাস না করে সংসদের বাছাই কমিটির মাধ্যমে আরো যাচাই বাছাই এর প্রস্তাব দেন। জাসদ এর মাইন উদ্দিন খান বাদল এই বিলটির যারা সমালোচনা করছেণ তাদের সমালোচনা করে বলেন, তারা বিরোধীতা করলেও বলছেন না বিলটি কোথায় অসঙ্গতি রয়েছে। তিনি বলেন জবাবদিহিতার উর্ধে একমাত্র আল্লাহ। তাই বিলটি জনমত যাচাই এ পাঠালেও একই উত্তর ফেরত আসবে।



মন্তব্য চালু নেই