শ্রীমঙ্গলে স্মৃতিময় ২শ’ বছরের ডিনস্টন

সৌরভ আদিত্য, শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধিঃ প্রিয়তম স্বামীর অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে জেসিজি ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ইংল্যান্ডে বসে তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামীর মৃত্যু সংবাদ জেনে এদেশে ছুটে আসেন স্বামীকে একনজর দেখতে। বৃট্টিশ নারী জেসিজির সাথে স্বামীর শেষ দেখা আর হয়নি। শ্রীমঙ্গলের ২শ’ বছরের স্মৃতিবিজড়িত এক সিমেট্রিতে নাম পরিচয়হীন কবরের একটিতে শুয়ে আছেন জেসিজির স্বামী। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা ডিনস্টন চা বাগানে অবস্থিত সেই ডিনস্টন সিমেট্রিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ৪৬ জন বৃট্টিশ নাগরিকসহ আরও ৯ শিশু।

ডিনস্টন সিমেট্রির যে পাঁচটি সমাধির পরিচয় ফলক নেই সেই সমাধির একটিতে ব্রিটিশ নাগরিক ‘জেসিজি’ লিখে গেছেন ‘ইন লাভিং মেমোরি অব মাই হাজবেন্ড’। প্রিয়তম স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ‘জেসিজি’ সুদুর ব্রিটেন থেকে ছুটে আসেন শ্রীমঙ্গলে। কিন্তু শেষ দেখা দেখতে পারেননি স্বামীর মরদেহ। ফলে মরদেহের ফলকে লিখে গেছেন উক্তিটি। এখনও এ কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অনেক বিদেশি নাগরিক স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসার এ উক্তি পড়ে অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে ওঠেন।

দি কনসলিডেন্ট টি এণ্ড ল্যান্ড কোম্পানীর মালিকানাধীন জেমস ফিনলে’র ডিনস্টন চা বাগানে কোলাহলমুক্ত সুনশান নীরবতায় সিমেট্রি’টির অবস্থান। সবুজ পাহাড় ঘেরা সিমেট্রির রক্ষণাবেক্ষণ করছে ফিনলে চা কোম্পানী। নিকট অতীতে এটি ঢাকাস্থ বৃট্টিশ দূতাবাস থেকে দেখভালো করা হতো বলে স্থানীয়রা জানান।

সূত্র জানায়, ১৮৫৪ সালে দেশে প্রথম সিলেটের মালনিছড়ায় চা বাগান প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮০ সালে শ্রীমঙ্গলে বৃট্টিশরা বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। সে সুবাদে সুদূর গ্রেট বৃটেন থেকে এখানে টি প্ল্যান্টার্স এবং অখণ্ড ভারতের আসাম ও উড়িষ্যা থেকে শ্রমিক আনা হয়। মূলত চা ব্যবসাকে ঘিরে এ অঞ্চলে বৃট্টিশ নাগরিকদের আগমন ঘটে। সে সময় শ্রীমঙ্গলে বৃট্টিশ দূতাবাসের সাব অফিস স্থাপন করা হয়।
বর্তমানে এটি টি বোর্ড’র নিয়ন্ত্রণে রিসোর্ট ও টি মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে বসবাসকারী তৎকালীন সময়ে যেসব বৃটিশ নাগরিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা যান, তাদের ডিনস্টন’র এই সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। সূত্র জানায়, সিমেট্রির সমাহিত প্রথম সদস্য হলেন বৃট্টিশ নাগরিক রবার্ট রয়বেইল। এই বাগানে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৮৮৫ সালের ৩০ আগস্ট ৩৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ১৮৯৬ সালের জুন মাসে শিশু উইলিয়াম জন ও ডেভিড সহাবি’র মৃত্যু হলে তাদের এখানে সমাধিস্থ করা হয়। ১৯১৮ সালের ১৮ মে জর্জ উইলিয়াম পিটার নামে আরেক বাগান ম্যানেজার’র স্ত্রী মেরি এলিজাবেথ’র মৃত্যু হলে তাকেও এখানে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে ১৯১৯ সালের ২ অক্টোবর জর্জ উইলিয়াম পিটারও মৃত্যুবরণ করেন। ডিনস্টন সিমেট্রির কঠিন শ্বেত পাথরের আচ্ছাদনে সহধর্মিণী মেরি এলিজাবেথ’র কবরের পাশে তাকেও সমাহিত করা হয়।

১৮৯৬ সালের জুলাই মাসে সমুদ্রপথে ইংল্যান্ডে ফেরার পথে মারা যান রামসান্টার নামে এক বৃট্টিশ আর ১৯০৩ সালের ১৭ জুলাই মারা যান ২৯ বছর বয়সী বৃট্টিশ নারী চিকিৎসক মেরী হেলেন টার্নার। তাদের মরদেহের হদিস আজও পাওয়া যায়নি। তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্বামী আর বন্ধুদের উদ্যোগে ডিনস্টন সিমেট্রিতে দু’টি প্রতীকী সমাধি নির্মিত হয়। টার্নারের স্বামী শ্বেত পাথরের সমাধিতে খোদায় করে লিখে রেখেছেন ‘ইন লিভিং মেমোরি অব মেরী হেলেন টার্নার’।

অ্যাডওয়ার্ড ওয়ালেস তার ২৫তম জন্মদিনে ১৯১৯ সালের ২০ জানুয়ারি হবিগঞ্জের দারাগাঁও চা বাগান এলাকায় মারা যান। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৭ সালের ১৩ মার্চ হান্ট নামের এক বৃটিশ নাগরিক মারা যান। অ্যাডওয়ার্ড ওয়ালেসসহ তিনিও এই সিমেট্রিতে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।

১৯৩৯ সালের বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মিত্র বাহিনীর একটি যুদ্ধ বিমান পার্শ্ববর্তী শমশেরনগর বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নকালে শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন চা বাগানের পাশে ক্রাশ করে। এ দুর্ঘটনায় নিহত বিমানের দু’জন পাইলটকে ডিনস্টন সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের দেহভষ্ম কবর থেকে উত্তোলন করে নিজ দেশে নিয়ে যায় মার্কিন বাহিনী।

১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৩৫ বছর বয়সী গিলবার্ড হেনরিটেটের পুত্র তার পিতার সমাধি দেখতে ডিনস্টন সিমেট্রিতে এসেছিলেন। গিলবার্ট হেনরির স্ত্রীর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তার মৃত্যুর পর মরদেহের ভষ্ম প্রিয়তম স্বামীর পদপ্রান্তে অশ্রুসজল নয়নে রেখে গেছেন পুত্র পিটারটেট। সিমেট্রিতে দায়িত্বরত চৌকিদার জানান, চা বাগানের সংরক্ষিত এলাকায় থাকার কারণে এই সিমেট্রি দেখতে বাঁধার মুখে পড়তে হয় পর্যটক ও সাধারণ দর্শনার্থীদের। সিমেট্রির পরিবেশ, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা রক্ষার প্রয়োজনে সর্বসাধারণের প্রবেশ ও ছবি তোলার ক্ষেত্রে কিছুটা বিধি-নিষেধ রয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষের।



মন্তব্য চালু নেই