তার নিয়ন্ত্রণে ৫০ দালাল

শীর্ষ মানব পাচারকারী রেবি ম্যাডামের অজানা কাহিনী

কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার উপকূলীয় জালিয়াপালং ইউনিয়নের শীর্ষ মানবপাচারকারী হিসেবে ম্যাডাম রেবিকে সবাই এক নামে চেনে। সোনারপাড়া গ্রামের এক সময়ের হতদরিদ্র কৃষক পরিবার নুরুল কবিরের স্ত্রী রেজিয়া আক্তার আজকের আলোচিত মানবপাচারকারী রেবি ম্যাডাম হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছে। পুলিশের খাতায় নাম থাকলেও স্বরাষ্টমন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম না থাকায় এলাকাবাসীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের আর্শিবাদ থাকায় সে বারবার রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে মানবপাচারের মত অহরহ মামলা থেকে। ২০১২ সাল থেকে রেবি ম্যাডাম মানবপাচারের সাথে সরাসরি জড়িত পড়ে। তার স্বামী নুরুল কবির বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন সংগ্রহ করে তার বাড়ীতে রেখে সুযোগ বুঝে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দিতো ট্রলার করে।

এভাবে চলতে থাকে তার মানবপাচার বাণিজ্য। মালয়েশিয়া থেকে থাইল্যান্ডে গভীর জঙ্গলে গোপন আস্তানা থেকে পাচারকৃত লোক গুলো মানবপাচারের দালাল। ধীরে ধীরে এ রেবি ম্যাডাম কোটিপতির তালিকায় নাম উঠে যাওয়ার কারণে এলাকায় কাউকে পরোয়া না করে প্রকাশ্যে এ জঘন্যতম কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

এক সময় জীবনবীমা কোম্পানীতে চাকুরীর মাধ্যমে জীবন জীবিকা নির্বাহ করলেও তার সংসারে ছিল অভাব অনটন। রেজিয়া আক্তারের স্বামী নুরুল কবির টানাপোড়নের সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মানবপাচার কাজে জড়িয়ে পড়ে। এসময় উপকূলের মেরিন ড্রাইভ ও কক্সবাজার টেকনাফ সড়কের কোটবাজার সী-বিচ সড়ক দিয়ে অহরহ লোকজন জড়ো হতো সোনার পাড়া বাজারে। বলতে গেলে এসময় সোনারপাড়া, ইনানী, নিদানিয়া এলাকায় মালয়েশিয়া যাত্রীর হাটবসতো। রেবির স্বামী নুরুল কবির এসময় লোকজন সংগ্রহ করে সাগর পথে পাচার করে দেওয়ার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হলে নুরুল কবিরের বাড়ীতে এসব লোকজনদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নিরাপদে রাখতো। থাকা-খাওয়া বাবদ খাতেও তারা স্বামী স্ত্রী অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অসহায় মালয়েশিয়া যাত্রীদের নিকট থেকে।

চলতি বছরের ২১ জানুয়ারী রেবি ম্যাডামকে মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগে তার স্বামী নুরুল কবিরকে মানবপাচারের অভিযোগে উখিয়া থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করে দেয়। ইতিমধ্যে রেবি ম্যাডাম জামিনে মুক্ত হয়ে ২০১৪ সালে ২৩ নভেম্বর স্বামীকে মুক্ত করার জন্য কক্সবাজার আদালত পাড়ায় তদবিরের জন্য ঘুরাঘুরি করাকালে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল রেবি ম্যাডামকে আটক করে। এসময় পুলিশ তার ভ্যানিটি ব্যাগে তল্লাসী চালিয়ে ৮৪ লাখ টাকা এবং ২৭ লাখ টাকার ২টি ব্যাংকের চেকও উদ্ধার করে। এঘটনায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে ২ টি মামলা দায়ের করে। কিন্তু বারবার আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে ফের জড়িয়ে পড়ে মানবপাচার বাণিজ্যে।

উপকূলীয় এলাকায় দাবড়িয়ে বেড়ানো এ রেবি ম্যাডামের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৫০ সদস্যের একটি শক্তিশালী মানবপাচাকারী সিন্ডিকেট। তার বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় রয়েছে মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ৩টি মামলা। এছাড়াও কক্সবাজার সদর থানায় রয়েছে ২ টি মানবপাচার মামলা। তার স্বামী নুরুল কবিরের বিরুদ্ধেও রয়েছে মানবপাচারের ৬টি মামলা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, তার পরিবারের সকলেই মানবপাচার করে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। রেবি প্রায়সময় দম্ভোক্তি করে বলে বেড়ান কক্সবাজারের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রসাশনের কর্তাব্যাক্তিদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। থানার ওসি নাকি তার গায়ের লোমও স্পর্শ করতে পারবে না। ওসি নাকি তার ভ্যানিটি ব্যাগে থাকে।

অভিযোগ উঠেছে, যারা তার মানবপাচার কাজে বিরোধিতা করে তাদের উপর তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা, মামলাসহ তার লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নিরীহ লোকজনকে নির্যাতন করে থাকে। এ ভয়ে এলাকার অনেকেই মুখ খুলতে সাহস করে না।

এমন একটি ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে মানবপাচারের তথ্য প্রকাশ করার অভিযোগে রেবি ম্যাডামের নেতৃত্বে ২০/৩০ জনের ক্যাডার বাহিনী সোনারপাড়া বাজারে উপজেলা মানবপাচার প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদের মালিকানাধীন ঔষুধের দোকানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এসময় হামলায় আহত হন আব্দুল হামিদ। এ ঘটনায় উখিয়া থানায় আব্দুল হামিদ বাদী হয়ে রেবি ম্যাডাম সহ ১১ মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও রেবি ম্যাডামের প্রভাবের কারনে তা থমকে আছে।

আব্দুল হামিদ জানান, এর আগে রেবি ম্যাডামের স্কুল পড়–য়া মেয়েকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় একটি নারী নির্যাতন মামলা দায়ের করেন। এলাকায় তার রয়েছে ২০ দালালের মধ্যে তার অন্যতম সহযোগি হিসেবে সোনারপাড়া পরিষদ পাড়া এলাকার ছৈইয়্যা ও সোনারপাড়াস্থ পশ্চিম সোনাইছড়ি এলাকার মৃত আমির হামজার পুত্র মোঃ ছৈয়দ, মোঃ জমির, ছেপটখালীর শরিফ মাষ্টারের পুত্র মানবপাচারের উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ন্ত্রক আবুল কালাম, মনখালীর মোস্তফিজুর রহমান সিকদারের পুত্র ফয়েজ, জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক চেয়ারম্যান সহ অর্ধশতাধিক দালালেরা দেশের বিভিন্ন জেলায় সিন্ডিকেট তৈরি করে সাধারণ নিরীহ লোকজনদেরকে অল্প টাকায় কোটিপতি স্বপ্ন দেখিয়ে উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের অস্থায়ী এয়ারপোর্ট নামে খ্যাত বাদামতলী, রাজাপালং ইউনিয়নের সিকদার বিলের কালাইম্যা দালালের আস্তানায়, জুম্মাপাড়া এলাকার শাহপরীরদ্বীপ থেকে আসা ছানা উল্লাহর আস্তানায় মজুদ করে রেখে স্থানীয় থানা পুলিশের কথিত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নামধারী একশ্রেণীর দালালদেরকে ম্যানেজ করে রেজু মোহনে তীরে অপেক্ষাকৃত বোট দিয়ে পাচার করে থাকে বলে এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়।

জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোছাইন চৌধুরী জানান, রেবি ম্যাডাম এলাকার জন্য অভিশাপ। তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনের তত্ত্বাবধানে উপকূলীয় এলাকা দিয়ে হাজারেরও অধিক লোকজন সাগর পথে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে উখিয়া সহকারী পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, শুধু ম্যাডাম রেবি নয়, যাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। যতবড় প্রভাবশালী হউক না কেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা।



মন্তব্য চালু নেই