শিক্ষকরাই পড়তে জানেন না পাহাড়ী ভাষার বই

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী শিশুদের জন্য বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মত তাদের মাতৃভাষায় বই ছাপানো হয়েছে। পাহাড়ী ভাষার অক্ষরে সেই বই তৈরি করা হয়েছে। স্কুলের কোমলমতি শিশুদের দেয়া হয়েছে নতুন বই। কিন্তু অনেক শিক্ষকই তা পড়াতে জানেন না। কারণ হিসেবে শিক্ষকরা বলছেন, তারা নিজেরাই এসব ভাষার বর্ণমালা জানেন না। তাই শিশুদের পড়াবেন কিভাবে তা নিয়ে সংকটে পড়েছে নতুন এই উদ্যোগ।

এ নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাঙ্গামাটি শহরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা মেফ্রু মারমা। তিনি বলছেন, আমরা তো আগে কখনও মারমা বা চাকমা বর্ণমালার বিষয়ে কিছু জানি নাই, বর্ণগুলোর সাথে তো আমরা পরিচিত না। এই স্কুলটিতে মারমা, চাকমা এবং ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা পড়ে। এ বছরই প্রাক-প্রাথমিক স্তরের জন্য পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় লেখা বই দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এই শিক্ষিকা বলছেন, এসব ভাষার বর্ণমালা না জানাটা ভিন্ন ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের জন্য একটা সমস্যা। বইগুলো কীভাবে পড়ানো হবে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের আগেই দেয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

রাঙ্গামাটির সদর উপজেলা থেকে জীবতলী হেডম্যানপাড়ায় ইঞ্জিন বোটে করে যেতে সময় লাগে দেড় ঘন্টা। ওই পাড়ায় অবস্থিত একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম দেখতে, মাতৃভাষায় রচিত পাঠ্যবই দিয়ে স্কুলে কেমন লেখাপড়া হচ্ছে। এটি মূলত চাকমা সম্প্রদায় প্রধান স্কুল। বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশোনার জন্য যে বই বিতরণ করেছে, তা এই স্কুলটিও পেয়েছে।

নতুন বই পেয়ে কেমন লাগছে তা অবশ্য শিশুদের কাছ থেকে জানা যায়নি। তবে স্কুল শিক্ষক জ্যোতির্ময় চাকমা জানালেন, বইটিতে আছে ছবির মাধ্যমে বিভিন্ন সংখ্যার সাথে পরিচয়, বর্ণ পরিচয়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পড়ার জন্য বই বিতরণ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। আপাতত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, এবং সাদ্রি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় একটি করে বই দেয়া হয়েছে। এদের জন্য সারা দেশে প্রায় ২৫ হাজারের মতো বই বিতরণ করা হয়েছে।

রাঙ্গামাটির বাসিন্দা প্রতিমা চাকমা – বাবা-মায়ের অবর্তমানে তিনি নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করেন।নিজের ভাষাতে কখনও লিখতে ও পড়তে শেখেননি প্রতিমা চাকমা। কিন্তু শিশুরা এখন সেই সুযোগ পাচ্ছে তাতে তিনি বেশ খুশি। বাংলাদেশে আছি বলে আমি বাংলা ভাষায় সব বুঝি। আমাদের ভাষায়তো বুঝতে পারি নাই, লেখাও বুঝি নাই। শিশুরা এখন বুঝতে পারবে।

২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৭টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাস। সরকারি হিসেবে সব মিলিয়ে জনসংখ্যা ১৬ লাখের মতো। এসব গোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশোনার সুযোগ এর আগে কিছুটা মিলেছে উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায়। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে এবারই প্রথম তারা মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
স্কুলগুলোতে যে শুধুমাত্র একটিমাত্র সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী পড়ে তা নয়। বেশ কিছু স্কুল রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের।

রাঙ্গামাটির জীবতলীর চেয়ারম্যান পাড়ায় একটি সরকারি স্কুলে রয়েছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা শিক্ষার্থী।প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষিকা মেফ্রু মারমা বলছিলেন, বইগুলো আমরা পেয়েছি ঠিকই। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনও নির্দেশ আসেনি অফিস থেকে, আমরা কোনও ট্রেনিং পাই নাই। তাই বেশি কিছু করা হয়নি। তিনি বলেন, তারা আগে থেকে মারমা বা চাকমা বর্ণমালার সাথে পরিচিত ছিলেন না। তাই বইগুলো কীভাবে পড়ানো হবে এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ আগে থেকে দেয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

আর বর্ণগুলো সম্পর্কে ঠিকভাবে না জানাটা হয়েছে ভিন্ন ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের জন্য একটা সমস্যা।

রাঙ্গামাটিতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করে স্থানীয় সংগঠন ‘গ্রিন হিলস’-এর কর্মকর্তা লাল সুয়াক নিয়েনা পাংখোয়া বলছিলেন, এতগুলো ভাষায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একটি জটিল ব্যাপার। ধরেন ১১টা সম্প্রদায় আছে পার্বত্য অঞ্চলে। এমন স্কুল আছে যেগুলোতে মিশ্র সম্প্রদায়ের শিশুরা ক্লাস করে। যেমন আমি পাংখো সম্প্রদায়, আমি চাকমা ভাষা পারবো না। তেমন যে চাকমা সম্প্রদায়ের সে আমার ভাষা পারবে না। প্রতিটি সম্প্রদায় প্রতিটি স্কুলে দেয়াটাতো খুবই কঠিন। এরকম উদ্যোগ যদি নেয়া যায় চাকমারাও আমার মারমা ভাষা পারলো, মানে একজনই বিভিন্ন ভাষা পারলো এমন মাল্টি-এক্সপার্ট তৈরি করা জরুরি- বললেন মি: পাংখোয়া।

অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান জানাচ্ছেন যে শিক্ষক তৈরির কাজ চলছে। ক্লাসে এই মুহুর্তে ঠিকভাবে পড়াতে পারছেন সেটা আমি বলবো না। আমাদেরে শিক্ষকদের মধ্যে যারা ট্রেনিং পেয়েছেন তারা একটু পড়াতে পারছেন, যারা ট্রেনিং পাননি তারা এক্সারসাইজ বুক দেখে পড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমরা শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। বড় একটা কাজ করতে গেলে চ্যালেঞ্জ থাকেই। এক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে – বলছেন জিল্লুর রহমান।

আর এই চ্যালেঞ্জের আরেকটি হলো প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার বর্ণমালা তৈরি করা। তবে এত বছর পর অবশেষে সরকার কিছু উদ্যোগ যে নিয়েছে, সেটিকেই স্বাগত জানাচ্ছেন অনেকে মন্তব্য করেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই