শিক্ষককে অসম্মান করে শিক্ষা নেহাতই অন্ত:সারশুন্য

মোঃ ওয়াহিদুল ইসলামঃ শুরুতেই শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারের ৬ মে ২০১৬ইং তারিখে চ্যানেল আই অনলাইনে ‘রুখে দাঁড়াবে বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি ‘সাদাসিদে কথা’ মতামতের কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই – বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির সামনে বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে বসেছিলাম। মাত্র কয়েকদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের মতোই একজন প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কয়েকজন কমবয়সী তরুণ মোটরসাইকেলে এসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। (আমি কত সহজেই না কথাটি লিখে ফেললাম। মানুষকে খুন করার এই প্রক্রিয়াটি কী ভয়ঙ্কর একটি নিষ্ঠুরতা অথচ কত দ্রুত আমরা এই নিষ্ঠুরতায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি!) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন প্রফেসর সিদ্দিকীর এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিল, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে এসে বসে থেকেছি। সেখানে বসে আমি ডানে-বামে তাকিয়ে হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম প্রফেসর সিদ্দিকীর মতো একজন মানুষকে যদি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা যায়, তাহলে আমার ডানে-বামে বসে থাকা যেকোনো একজন শিক্ষককেও আসলে যেকোনো সময় হত্যা করে ফেলা সম্ভব।

আমি স্যারের এই কথার সাথে একাত্মতা পোষন করে বলতে চাই শিক্ষকদের নিয়ে প্রতিটি ঘটনার পরে কিছুসংখ্যক শিক্ষকের মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল, মৌনমিছিলের মাধ্যমেই প্রতিবাদ শেষ হয়ে যায়। এখন আমার প্রশ্ন, আর কতটা অপমানিত হলে প্রাথমিক না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সে প্রশ্ন না তুলে সব শিক্ষক তাঁদের মর্যাদার প্রশ্নে এক হবেন ? শিক্ষকদের এই অমর্যাদা বেড়েই চলবে আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত এভাবে নিরব মৌন-মিছিল আর মানববন্ধনে সীমাবদ্ধ থাকবো। আমরা জাতি হিসেবে আর কত লজ্জিত হবো? তাঁর উত্তর আমার জানা নেই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের কোন সুরাহা হতে না হতেই ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ এনে গত ১৩ মে ২০১৬ইং (শুক্রবার) নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে একদল পিশাচরা মারধর করেন এবং তাঁকে কান ধরিয়ে উঠ-বস করান স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান। উপস্থিত জনতার কাছে প্রকাশ্যে মাফ চাইতেও বাধ্য করা হয় ওই শিক্ষককে।

হীরক রাজার দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে ক্ষমতাসীন রাজা দেশের মানুষের ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করেছিল। সভ্যতার এ যুগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে নতুনভাবে ক্ষমতার দাপট দেখানো হচ্ছে। এত দিন আর্থিক দীনতা থাকলেও সম্মানের ও শ্রদ্ধার আলাদা একটি স্থান বরাদ্দ ছিল শিক্ষকদের জন্য। এখন তা একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের রূপ নিয়েছে। শিক্ষকদের জন্য ‘ননসেন্স’ নামক বিশেষণ বরাদ্দ হয়েছে। অধিকার চাইতে গিয়ে শিক্ষকদের ভাগ্যে জুটেছে পেপার স্প্রে, গরম পানি, পুলিশের লাঠিপেটা, কান ধরে উঠবস, চাকুরীচ্যুত হওয়া সহ আরো অপমান ।

ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে অতি অত্যাচারী নিষ্ঠুর শাসকও নত শিরে গুরুর সম্মুখে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের ধৃষ্টতা কেউ দেখাননি। চাণক্য শ্লোকে আছে, এক অক্ষরদাতা গুরুকেও গুরু বলিয়া মান্য করিবে। এক অক্ষরদাতা গুরুকে যে গুরু বলিয়া মান্য করে না, সে শতবার কুকুরের গর্ভে জন্মগ্রহণ করে চণ্ডালত্ব লাভ করিবে।

শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড এই কথার ভিত্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের আর এখন উঠে দাঁড়াবার মত মেরু নেই আছে শুধু দন্ড তাই তাঁরা প্রতিনিয়ত দন্ড ভোগ করে অত্যাচারিত, নিপীড়িত আর অবহেলিত হচ্ছেন।

শুনেছি সমালোচিত এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের সাংসদ সেলিম ওসমানের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে অভিশংসন প্রস্তাব আনার দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অকর্মণ্য, অসভ্য, বর্বর এই ব্যাক্তিটির সাংসদ হিসেবে থাকার কোন অধিকার নেই।

পরিশেষে এ কথাই বলবো যে, শুধু উপরিউক্ত দুইটি ঘটনাই নয়, আরো অনেক ঘটনা ঘটছে যা হয়তো মিডিয়া পর্যন্ত পৌঁছেনি। তবে সরকার ইচ্ছে করলে অবশ্যই বের করতে পারবে। এসব ঘটনা বের না করে সরকার যদি মিডিয়ার ওপর বৈরী হয় তাহলে বলার কিছু নেই। তবে সরকার নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে বৈরী হবে না। কারন সরকার পরিচালনায় যারা রয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই আইয়ুব বা ইয়াহিয়া খানের মতো পাকিস্তানী সরকার নয়। তারা গর্বিত স্বাধীন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্ঠা পাকিস্তানবিরোধী সরকার। যে সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করেছে। যে সরকার ৪৫ বছর পরেও মানবতাবিরোধীদের বিচার চালিয়ে যাচ্ছে। সে সরকার নিশ্চয়ই এরূপ নরপশুদের বিচার করবে না, তা বিশ্বাস করা বড়ই কঠিন। সরকার নিশ্চয়ই গোটা জাতির বিবেককে হেয় প্রতিপন্ন করতে দিবে না। জাতিকে সাথে নিয়ে সমাজ থেকে এ সব দুষিত ব্যক্তিদের কঠোর বিচার করে নজির সৃষ্টি করবে।

মোঃ ওয়াহিদুল ইসলাম
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়



মন্তব্য চালু নেই