শরীরে ৪টি গুলি নিয়েও উদ্ধার ২ শিশুকে: সাহসিকতার অনন্য নজির সেনাকর্মীর

কোনো মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান এবং প্রিয় বলে বিবেচিত হতে পারে কোন জিনিসটি? অবশ্যই তার নিজের জীবন। অন্তত অধিকাংশ মানুষের কাছেই তাই। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষও রয়েছেন, যাঁরা নিজের প্রাণের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেন আর্ত এবং বিপদগ্রস্তের জীবনকে। মানবসেবা আর সাহসিকতার অনন্য নজির গড়েন তাঁরাই। তেমনই একজন মানুষ হলেন ভারতীয় সেনার অসমসাহসী কর্মী কর্নেল ডি পি কে পিল্লাই।

তারিখটা ছিল ২৫ জানুয়ারি, ১৯৯৪। কর্নেল পিল্লাই তখন ভারতীয় সেনার ক্যাপ্টেন পদাধিকারী। মণিপুর ছিল তাঁর কর্মস্থল। লাগাতার সশস্ত্র জঙ্গী আন্দোলনে মণিপুর তখন ক্ষতবিক্ষত। সেই উত্তপ্ত আবহেই সাধারণ মানুষকে সুরক্ষিত রাখার কাজে নিয়োজিত ছিলেন পিল্লাই আর তাঁর সঙ্গী জওয়ানরা। ১৯৯৪-এর ২৫ জানুয়ারি সেনা ছাউনিতে খবর আসে, জঙ্গীরা আক্রমণ হেনেছে আদিবাসী অধ্যুষিত তামেংলং গ্রামে। দলবল নিয়ে পিল্লাই গ্রামে পৌঁছন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গুলির লড়াই চলার পর কয়েকজন জঙ্গী গ্রামের একটি বাড়িতে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। পিল্লাই একাই এগিয়ে যান সেদিকে। বাইরে থেকে জঙ্গীদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান। জঙ্গীদের দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ঘরের ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেন ক্যাপ্টেন। কিন্তু লাথি মেরে দরজাটি খুলতেই গুলিবৃষ্টি শুরু হয় তাঁর উপর। প্রথম গুলিটি লাগে তাঁর কাঁধে। মুহূর্তের মধ্যে আরও তিনটি গুলি ঢুকে যায় তাঁর শরীরে। তারপর তাঁর দিকে গড়িয়ে আসে একটি হ্যান্ডগ্রেনেড। ক্যাপ্টেন পিল্লাই বোমাটিকে লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

কিন্তু বোমাটি ফেটে যায়, সেই সঙ্গে উড়ে যায় ক্যাপ্টেনের পায়ের একটি অংশও। কিন্তু পিল্লাই হার মানার পাত্র নন। তিনি ওই অবস্থাতেও লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত শত্রুপক্ষ পরাস্ত হয়। কিন্তু বিধ্বস্ত শরীরে ক্যাপ্টেন পিল্লাই দেখতে পান, এক অন্য লড়াই এখনো বাকি রয়েছে। তাঁর নজরে আসে ঘরের ভেতরে পড়ে রয়েছে দু’টি গুলিবিদ্ধ শিশু। গুরুতর জখম হলেও তাদের শরীরে এখনও প্রাণ রয়েছে। ক্যাপ্টেন পিল্লাই সঙ্গে সঙ্গে সংকল্প নেন, তিনি নিজে বাঁচুন, না-বাঁচুন, শিশু দু’টিকে বাঁচাবেনই।

কিছুক্ষণ পরে আর্তদের উদ্ধার করার জন্য ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার। কিন্তু অন্যান্য জখমদের তোলার পর দেখা যায়, আর একজনের মতো জায়গা রয়েছে হেলিকপ্টারে। সেনাকর্মীরা ক্যাপ্টেন পিল্লাইকে তুলে নিতে যান। কিন্তু পিল্লাই বাধা দিয়ে বলেন, তাঁকে হেলিকপ্টারে তুলতে হলে আহত শিশু দু’টিকেও তুলতে হবে। সেনাকর্মীরা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আহতদের হাসাপাতালে পৌঁছে ফের উড়ে আসবে হেলিকপ্টার। তখনই উদ্ধার করা হবে শিশু দু’টিকে। কিন্তু ক্যাপ্টেন পিল্লাই নাছোড়। তাঁর ভয়, তাঁকে নিয়ে উড়ে যাওয়ার পর দু’টি শিশুকে উদ্ধারের জন্য যদি তেমন গা না করে হেলিকপ্টার, যদি দেরি হয়ে যায়! তিনি জেদ ধরে রয়ে গেলেন আহত দুই শিশুর সঙ্গে। হাসপাতাল থেকে তড়ঘড়ি ফিরে এলো হেলিকপ্টার। দু’টি শিশুর সঙ্গে তোলা হল ক্যাপ্টেন পিল্লাইকেও। নিকটতম হাসপাতালের দূরত্বও কম নয়। হেলিকপ্টারেও যথেষ্ট সময় লাগবে সেখানে পৌঁছতে। পিল্লাই বুঝতে পারেন, তিনি বড়জোর আর মিনিট পাঁচেক বাঁচবেন। তিনি শান্ত গলায় হেলিকপ্টার চালককে বলেন, আমার জন্য চিন্তা করো না। শুধু দেখো, বাচ্চা দু’টো যেন বেঁচে যায়।

কিন্তু ভুল বুঝেছিলেন পিল্লাই। মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। হাসপাতালে বেশ কিছুদিন যমে-মানুষে টানাটানির পরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। পুনরায় যোগ দেন সেনাবাহিনীর কাজেও। আজ তিনি ভারতীয় সেনার কর্নেল পদে উন্নীত। সম্মানিত হয়েছেন শৌর্য চক্রে। আর সেই তামেংলং গ্রাম? সেই গ্রাম আর গ্রামের মানুষগুলিকে কি ভুলে গিয়েছেন পিল্লাই? না। আর ভোলেননি বলেই ২০১২ সালে আবার ফিরে যান সেখানে। গিয়ে দেখেন, তামেংলং-বাসীরাও মনে রেখেছেন তাঁদের এই রক্ষাকর্তাকে। বুকভরা ভালবাসা আর সম্মানে তাঁরা ভরিয়ে দিয়েছেন পিল্লাইকে। স্থানীয় ভাষায় আদর করে তাঁরা এখন কর্নেলকে ডাকেন ‌পিল্লাই পামেই নামে। আপ্লুত কর্নেলও এলাকার ও এলাকাবাসীদের উন্নয়নে প্রাণভরে চেষ্টা করছেন। তাঁর উদ্যোগে গ্রাম থেকে জেলা সদর যাওয়ার ২৮ কিমি দীর্ঘ পাকা রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। হচ্ছে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজও। আসলে মানবসেবাই যাঁর লক্ষ্য, তিনি সেনা জওয়ানের ভূমিকাতেই থাকুন কিংবা সমাজসেবীর— নিজের ব্রতে অবিচল থাকাই তাঁর ধর্ম। আর সে কথাই নিজের জীবনে বারবার প্রমাণ করেছেন কর্নেল ডি পি কে পিল্লাই। স্যালুট তাঁকে।-এবেলা



মন্তব্য চালু নেই