সিটি করপোরেশন নির্বাচন :

‘শত’ ‘সহস্রে’র লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের ‘একক’ বিলীন?

‘শত-সহস্রের লড়াইয়ে জমে উঠেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি দলপন্থি পেশাজীবীদের নড়েচড়ে বসা নতুন নয়। পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবী-সুশিলসমাজের পাল্টাপাল্টি লড়াইয়ের প্রতিযোগিতা নতুন না হলেও তাদের ‘নাম’ এর লড়াইয়ে নতুত্ব অনুভব করছেন অনেকে। ‘নাম’ নিয়েও প্রতিযোগিতা সাধারণ ভোটার ও নাগরিকদের মাঝে কৌতুহলেরও সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক কিংবা নির্বাচনী অঙ্গনে কারা কতো এগিয়ে থাকবে তা যতোটা না মূখ্য তার চেয়েও বেশি যেন ‘নাম’র লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা।
আসন্ন সিটি নির্বাচনে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অরাজনৈতিক সংগঠন ‘শত নাগরিক কমিটি’ ও আওয়ামীলীগপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অরাজনৈতিক সংগঠন ‘সহস্র নাগরিক কমিটি’র নাম নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ‘শত-সহস্রের লড়াইয়ে বড়-ই ‘একক’ হয়ে পড়েছেন অতিসাধারণ মানুষ ও ভোটাররা।

সিটি নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন ইস্যুতে ইতোমধ্যে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন এ’দুটি পেশাজীবী সংগঠন। কর্মকান্ডও চালাচ্ছেন নিজেদের গতিতে কিংবা অনেক সময় পাল্টাপাল্টি বিষয়েও। চলমান সিটি নির্বাচনের মাঠে সংগঠন গুলোর উত্থান সাধারণ মানুষের চোখে ফুটে উঠলেও তাদের পথচলা আরো আগে।

বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করেন এমন মানুষ নিয়ে ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু হয় ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামের অরাজনৈতিক সংগঠনটির। অরাজনৈতিকভাবে শুরু হলেও বর্তমানে তা রাজনৈতিক প্রলেপ লেগে গেছে এর গায়ে। বর্তমানে সংগঠনটির প্রায় সবাই বিএনপির রাজনৈতিক জোটের অনুসারী। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষিত তফশীলের আগে আলোচনা সভা, সেমিনারে আ.লীগের সমালোচনা করে আসলেও সংগঠনটি খুব বেশি আলোচনায় ছিল না কখনও।

তবে হঠাৎ করেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর আলোচনায় আসে এই ‘শত নাগরিক কমিটি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ও সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে ‘শত নাগরিক কমিটি’ সিটি নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত, বিএনপির নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করা, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ভোটগ্রহণ কক্ষে সিসি ক্যামেরা সংযোজন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিসহ নানান দাবি করে আসছেন।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- রাজধানী ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর নাম বিএনপি ঘোষনা না করলেও করেছে বিএনপিপন্থী এ অরাজনৈতিক সংগঠনটি। বিএনপি চেয়ারপার্সনের সম্মতিতে ‘শত নাগরিক কমিটি’ ঘোষিত প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছেন কর্মী-সমর্থকরা। চট্টগ্রামের সদ্য সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা মঞ্জুর আলমের পক্ষে সেখানকার হাইভোল্টেজ নেতারা একযোগে কাজ শুরু করলেও কিছুটা ভাটা লক্ষণীয় ঢাকার দুই সিটিতে। কিছুটা আকষ্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবেই ঢাকার দু’টি সিটিতে প্রার্থী ঘোষনা করেন এ সংগঠনটি।

রাজধানী ঢাকার উত্তর সিটিতে মেয়র প্রার্থী বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর মনোনয়নপত্রে দাখিলকৃত সমর্থক ব্যক্তি ঢাকা সিটির ভোটার না হওয়ার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি সাধারণ বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা। শেষমেশ মিন্টুর ছেলে রাজনীতি ও নির্বাচনে সম্পূর্ণ নতুন মুখ তাবিথ আউয়ালকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেয়ার বিষয়টিও পরিকল্পিত বলে ধারণা তাদের। আর ঢাকা দক্ষিনে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসকে সমর্থন দেয়ার বিষয়টিও অনেকে বাঁকা চোখে দেখেছেন। দলের স্থায়ী কমিটির এ সদস্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগরের আহবায়কের দায়িত্ব পেলেও গেলো আন্দোলনের সময় যেমন মাঠে পাওয়া যায়নি ঠিক তেমনি বহু মামলার বেড়াজালে পেচিয়ে তাকে থাকতে হয়েছে আত্মগোপণে।

এখনো পর্যন্ত তিনি স্বশরীরে নির্বাচনী মাঠে নামতে পারেননি। মাঠে থাকতে পারেন এমন কোন প্রার্থীকে সমর্থনের প্রত্যাশাও গলাটিপে ধরা হয়। দল ক্ষমতায় গেলে এসকল নেতা যেহেতু সম্মানীয় পদে আসীন হবেন সেহেতু বর্তমান প্রেক্ষাপটের বিচারে মাঠে সাধারণ সমর্থকদের পাশে থাকতে পারেন এমন নেতাকেই সমর্থন দেয়া বাঞ্চনীয় ছিল এমনটাই মনে করছেন সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা। তবুও বাধ্য হয়ে দলের টানে নির্বাচনী প্রচারণায় ইতোমধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা। যদিও প্রচারণায় হাইভোল্টেজ বহু নেতাদের চেহারা সার্বক্ষনিক এখনো চোখে পড়েনি। কেউ কেউ আবার গা বাঁচানোর তাগিদে কিছুটা সময় পারও করছেন। তবে শনিবার থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন। গত ৩দিন ধরে তিনি বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন।

নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় সোমবার বিকেল ৬টার দিকে ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এসময় বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অনেকটা নিশ্চুপ-নিষ্ক্রিয় ও অসহায় দেখা যায়।

এদিকে, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী উত্তরের আনিসুল হক ও দক্ষিণে সাঈদ খোকনের সমর্থনে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে আহবায়ক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছকে সদস্যসচিব করে ‘সহস্র নাগরিক কমিটি’ গঠিত হয়েছে। দৃশত ‘শত নাগরিক কমিটি’র পাল্টা হিসেবে গত সপ্তাহে ‘সহস্র নাগরিক কমিটি’ গঠনের ঘোষণার সঙ্গে এর আগে গঠিত ঢাকা নাগরিক সমাজের বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়া হয়।

সিটি নির্বাচনের তফশীলের আগে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং গণভবনে ডেকে আনিসুল হক, সাঈদ খোকন ও চট্টগ্রামের আজম নাছিরকে মেয়র প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার পর থেকেই আ.লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে তারাই গণ্য হয়ে পড়েন। পরে আ.লীগপন্থী ‘সহস্র নাগরিক কমিটি’ তাদের সমর্থন দেন।

ঢাকা উত্তরে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেক নেতার স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আ.লীগ রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হককে সমর্থন দেয়ার বিষয়টিও প্রান্তিক কর্মী-সমর্থকরা ঠিকঠাক মেনে নিতে পারেননি। তবু রাজনৈতিক চাপে ও টানে মাঠে নেমে পড়েছেন তারাও। দক্ষিণেও একই চিত্র। তবে সাঈদ খোকনের পাল্লাটা কিছুটা হলেও ভারি। সেখানে প্রার্থীতা থেকে হাজী সেলিম সরে এসে তাকে সমর্থন দেয়া ও প্রতিপক্ষ প্রার্থী মির্জা আব্বাস এখনো মাঠে নামতে না পারায় কিছুটা হলেও ফুরফুরে মেজাজে আছেন তিনি। সোমবার প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের তিনটি সিটিতে দল সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে নির্দেশ দেন বলে জানা গেছে।

সবমিলিয়ে ‘শত’-‘সহস্র’ এর লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জের চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সুষ্টু পরিবেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার বিষয়টি। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে মূল চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সাধারণ ভোটার ও নাগরিকরা। জনগণের রায়ের প্রত্যাশা আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান এখনো অনেকে। ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটদানের মাধ্যমে সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচিত হবেন এবং জনগণের রায় সকল পক্ষ মেনে নেবেন এমনটাই দাবি সাধারণ মানুষের। এখন শুধু দেখার বিষয় সাধারণ মানুষের ‘একক’ রায়ের প্রতিফলন কোন দিকে যাবে ‘শত’ না ‘সহস্র’ -এ। নাকি ‘শত’ ‘সহস্রে’র লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের ‘একক’ বিলীন হয়ে যাবে?



মন্তব্য চালু নেই