শততম টেস্টে ঐতিহাসিক জয়

জয়টা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল চতুর্থদিন শেষ বিকেলেই। যদিও শ্রীলংকার শেষ দুই ব্যাটসম্যান কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন; কিন্তু আজ সকালে সাকিব আল হাসানের সামনে সেই প্রতিরোধও ভেঙে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামনে শততম টেস্টে জয়ের জন্য লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৯১ রান।

লক্ষ্যটা সহজ হলেও পি সারা ওভালের শেষ দিনে স্পিন বান্ধব উইকেটে বাংলাদেশ পারবে তো ইতিহাসটা গড়তে? সংশয়বাদীদের মনে শঙ্কার কালোমেঘ কিছুটা জমেছিল বৈ কি! কিন্তু তামিম ইকবালের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের সঙ্গে সাব্বির রহমানের দৃঢ়তা এবং সাকিব-মুশফিকের মাঝারি মানের একটি জুটি, শেষ পর্যন্ত ইতিহাস সৃষ্টি করেই দিল বাংলাদেশকে।

শততম টেস্টে ঐতিহাসিক জয়। শ্রীলঙ্কাকে তাদের মাটিতে ৪ উইকেটে হারিয়েই ইতিহাসটা গড়লেন মুশফিকুর রহীম অ্যান্ড কোং। গত অক্টোবরে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে যে ইতিহাস তৈরি করেছিল টাইগাররা, সেই ইতিহাসকে তারা টেনে নিয়ে গেলো কলম্বোয়। গল টেস্টে কিছুটা হতাশার জন্ম দিলেও কলম্বোয় নিজেদের শততম টেস্টে এসে দারুণ উজ্জীবিত বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক জয়ে ফিনিশং টাচটা এঁকে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

এই শ্রীলঙ্কাই গত বছর নিজেদের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার মত দলকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছিল। পি সারা ওভালে আগে যে তিনটি ম্যাচ খেলেছিল বাংলাদেশ, সবগুলোতেই ছিল ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়। শ্রীলঙ্কার সেই শক্তি হয়তো এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে, এই দলটিই তো অস্ট্রেলিয়াকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছিল। আবার এই দলটিই তো গল টেস্টে বাংলাদেশকে হারিয়েছিল ২৫৯ রানের বিশাল ব্যবধানে।

সেই দলটির সামনেই কলম্বোর পি সারা ওভালে এসে পুরোপুরি বদলে গেলো বাংলাদেশ। যদিও এই বদলটা একাদশ দিয়েই শুরু করেছিল মুশফিক অ্যান্ড কোং। শততম টেস্টের আগেই দল থেকে বাদ পড়লেন অপরিহার্য দুই ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর মুমিনুল হক। বাদ দেয়া হলো আরেক অপরিহার্য বোলার তাসকিনকে। ইনজুরির কারণে বাদ পড়লেন লিটন কুমার দাসও।

চার পরিবর্তন নিয়ে খেলতে নামা বাংলাদেশ দাপট দেখাচ্ছিল প্রথম দিন থেকেই। টস হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ফিল্ডিং করতে নেমে লঙ্কানদের উইকেটের সুবিধা কোনোভাবেই কাজে লাগাতে দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। একা এক দিনেশ চান্দিমাল ছাড়া কেউ দাঁড়াতে পারেনি মোস্তাফিজ-মিরাজদের সামনে। চান্দিমালের ১৩৮ রানের ইনিংসের ওপর ভর করে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ দাঁড়িয়েছিল ৩৩৮ রান।

জবাব দিতে নেমে শুরুটা দারুণ ছিল বাংলাদেশের। তামিম আর সৌম্য মিলে ৯৫ রানের জুটি গড়ার পরই মনে হচ্ছিল বড় ইনিংস খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।; কিন্তু টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষ বিকেলে হঠাৎ একের পর এক উইকেট হারিয়ে শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ৫ উইকেটে ২১৪ রান নিয়ে দিন শেষ করার পর সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হতে শুরু করেন সাকিব আল হাসান।

তৃতীয় দিন মাঠে নেমে পুরোপুরি বদলে যান সাকিব। তার অসাধারণ এক সেঞ্চুরির সঙ্গে, হাফ সেঞ্চুরি উপহার দেন মুশফিকুর রহীম। ১১৬ রান করে সাকিব আউট হন। এরপর মুশফিক করেন ৫২ রান। অভিষিক্ত মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত করেন ৭৫ রান। যার সুবাধে বাংলাদেশের রান ৪৬৭। পেয়ে গেলো ১২৯ রানের বিশাল লিড। বিদেশের মাটিতে যা সর্বোচ্চ।

দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেনার দিমুথ করুণারত্নে সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশের সামনে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল শ্রীলংকা; কিন্তু মোস্তাফিজ আর সাকিবের বোলিং তোপে সে প্রতিরোধ আর টেকেনি। যদিও নবম উইকেট জুটিতে ৮০ রানের জুটি গড়ে সুরঙ্গা লাকমাল আর দিলরুয়ান পেরেরা বাংলাদেশের স্বপ্ন কেড়ে নিতে চাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আজ সকালে দু’জনের এই জুটি বিচ্ছিন্ন হয় মিরাজ-সুভাশিসের দুর্দান্ত এক রান আউটের শিকার হয়ে। এরপর বাকি উইকেটটাও ঝুলিতে পুরে নেন সাকিব।

শততম টেস্টে ঐতিহাসিক জয়ের জন্য লক্ষ্য দাঁড়ালো ১৯১। বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল শ্রীলংকাকে লিডটা ১৬০ এর বেশি নিতে না দেয়া। শেষ পর্যন্ত সেটা হলো ১৯০। অন্তত ৩০ রান বেশি। তবে তামিম আর সৌম্যর ব্যাটে সেই বাধা ধীরে ধীরে দূর হতে থাকে। যদিও রঙ্গনা হেরাথের এক ওভারের ঝরে হঠাৎই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। পরপর দুই বলে ফেরেন সৌম্য এবং ইমরুল। সৌম্য ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন। ইমরুল বোকা বনে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দেন।

যদিও তামিম আর সাব্বিরের ব্যাটে জয়ের পথেই এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। দু’জনের ১০৯ রানের দুর্দান্ত জুটি বাংলাদেশের জয়ের ভিতেই গড়ে দেয়। যদিও ৮২ রান করার পর কেন যেন তার মাথায় রক্ত চড়ে বসলো তামিমের। দিলরুয়ান পেরেরার বলে বিগ শট খেলতে গেলেন তামিম ইকবাল। লংঅনে ওঠা ক্যাচটি ঝাঁপিয়ে পড়ে তালুবন্দী করলেন দিনেশ চান্দিমাল।

৮২ রান করার পরও তাই তার ইনিংস একটা আক্ষেপ হয়েই থাকলো। শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করে ২৮তম জন্মদিনটা রাঙিয়ে দিতে পারলেন না বাংলাদেশের এই ড্যাশিং ওপেনার।

তামিম আউট হলেও উইকেটে ছিলেন সাব্বির রহমান। নিজেকে অনেকটাই সেট করে নিয়েছিলেন তিনি। ৭৬ বলে ৪১ রান করার পর তিনিও যে সেই পেরেরার বলে এলবিডব্লিউর শিকার হলেন তিনি। যদিও আউটটা এলো ডিআরএসের মাধ্যমে। আম্পায়ার এস রবি আউট না দিলেও লঙ্কানরা ডিসিশন রিভিউ চায়। সেখানেই দেখা গেলো সাব্বির লেগ বিফোরের শিকার।

এই চার উইকেট চলে যাওয়ার পর উইকেটে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি সাকিব আল হাসান এবং মুশফিকুর রহীম। যদিও দু’জন মাত্র ১৯ রানের জুটি গড়তে সক্ষম হন।

সেই দিলরুয়ান পেরেরা বলেই আচমকা উইকেট হারিয়ে বসেন সাকিব। পেরেরার বলটি কাট করতে চেয়েছিলেন সাকিব। বল ব্যাটের কানায় লেগে স্ট্যাম্প ছুঁয়ে যায়। কিন্তু আম্পায়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না, আসলেই বল স্ট্যাম্প ছুঁয়ে গিয়েছিল নাকি উইকেটরক্ষক ডিকভেলার প্যাডে লেগে এসে বল আঘাত হেনেছে স্ট্যাম্পে। পরে থার্ড আম্পায়ার কল করে সাকিবকে আউট ঘোষণা করা হয়। তখন বাংলাদেশের রান ১৬২।

সাকিবের আউট হওয়ার সময়ও ২৯ রান প্রয়োজন বাংলাদেশের। উইকেটে ছিলেন তখন মুশফিক আর মোসাদ্দেক। দু’জনই প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান; কিন্তু সাকিবের আউটটা শঙ্কার কালো মেঘ তৈরি করেই দিয়ে গিয়েছিল বৈ কি। লো। তবে এরপর মুশফিকের সঙ্গে জুটি বেধে বাংলাদেশকে জয়ের দিকেই নিয়ে যাচ্ছিলেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। এর মধ্যে একবার মুশফিককে আউট দিয়ে দিয়েছিলেন আম্পায়ার এস রবি। যদিও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। এরপর মোসাদ্দেকের রিটার্ন ক্যাচ ফেলে দেন রঙ্গনা হেরাথ।

তবুও, হেরাথের বলেই নিরোশান ডিকভেলার হাতে ক্যাচ দিয়ে জয়ের মাত্র ২ রান দুরে থাকতেই আউট হয়ে যান মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। একই ওভারের পঞ্চম বলেই অফসাইডে কিছুটা ফুলটসের মত বল পেয়েছিলেন মিরাজ। সেটাকেই সুইপ করে শর্ট ফাইন লেগে ঠেলে দিয়ে দ্রুত দু’বার জায়গা বদল করেই শততম টেস্টে বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন মিরাজ আর মুশফিক।

সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড
টস : শ্রীলঙ্কা, ব্যাটিং। শ্রীলংকা ১ম ইনিংস : ৩৩৮/১০, ১১৩.৩ ওভার (দিনেশ চান্দিমাল ১৩৮, লাকমাল ৩৫, ধনঞ্জয়া ডি সিলভা ৩৪, নিরোশান ডিকভেলা ৩৪, রঙ্গনা হেরাথ ২৫, থারাঙ্গা ১১; মিরাজ ৩/৯০, মোস্তাফিজ ২/৫০, শুভাশিস রায় ২/৫৩, সাকিব আল হাসান ২/৮০, তাইজুল ১/৪০)।

বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস : ৪৬৭/১০, ১৩৪.১ ওভার (সাকিব ১১৬, মোসাদ্দেক ৭৫, সৌম্য ৬১, মুশফিক ৫২, তামিম ৪৯, ইমরুল ৩৪, সাব্বির ৪২, মেহেদী হাসান মিরাজ ২৪; হেরাথ ৪/৮২, সান্দাকান ৪/১৪০, ২/৯০)।

শ্রীলংকা দ্বিতীয় ইনিংস : ৩১৯/১০, ১১৩.২ ওভার (কুরনারত্নে ১২৬, দিলরুয়ান পেরেরা ৫০, লাকমাল ৪২, কুশল মেন্ডিস ৩৬, থারাঙ্গা ২৬; সাকিব ৪/৭৪, মোস্তাফিজুর রহমান ৩/৭৮, তাইজুল ইসলাম ১/৩৮, মিরাজ ১/৭১)।

বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস : ১৯১/৬, ৫৭.৫ ওভার (তামিম ৮২, সাব্বির ৪১, মুশফিক ২২*, মোসাদ্দেক ১৩, সাকিব ১৫, সৌম্য ১০, মিরাজ ২*; হেরাথ ৩/৭৫, পেরেরা ৩/৫৯)।

ফল : বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী। ম্যান অব দ্য ম্যাচ: তামিম ইকবাল, ম্যান অব দ্য সিরিজ : সাকিব আল হাসান।



মন্তব্য চালু নেই