শঙ্কিত তসলিমার জন্মদিন আজ

তসলিমা নাসরিন দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাসিত রয়েছেন। তিনি বলেছেন হত্যার হুমকি পেয়ে ভারত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। সর্বশেষ তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। হত্যার হুমকির বিষয়টি তিনি টুইটারেও লিখেছেন। তসলিমা নাসরিন লিখেছেন, দিল্লিতে আর নিরাপদ বোধ করছেন না তিনি।

তসলিমা তার টুইটারে আরো উল্লেখ করেছেন- বাংলাদেশে সম্প্রতি যারা ব্লগারদের হত্যা করছে তারাই তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে তিন জন ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। টুইটারে তসলিমা নাসরিন আরও লিখেছেন- তিনি একেবারে ভারত ছেড়ে যাননি, যখন নিরাপদ বোধ করবেন তখন তিনি সেখানে ফিরে যাবেন। এ খবর গত ৩ জুনের। কিন্তু তিনি ভারত ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান গত ২৭ মে।

১৪ জুন আবার কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কেন আমেরিকায় এলাম’ শিরোনামে তসলিমা নাসরিন লেখেন, ‘ভাইরাসের মতো খবরটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছি আমেরিকায়। কেন? আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের খুনিরা, যারা অভিজিৎ-ওয়াশিকুর-অনন্তকে কুপিয়ে মেরেছে, তারা আমাকেও মেরে ফেলবে-এই ভয়ে। এতই যদি আমার ভয়, তা হলে ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও, কেন বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য এত চেষ্টা করেছি? আর, কেনই বা বছরের পর বছর ভারতে শুধু থাকিইনি, থাকার জন্য যুদ্ধও করেছি? এ দুটো দেশেই তো জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, এ দুটো দেশেই আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে, আমার ওপর শারীরিক আক্রমণ হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছে, আমার মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে। এ দুটো দেশেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওত পেতে থাকে। এত কাল পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত আমি ভয় পেয়ে পালাব? পালিয়ে যাওয়ার মানুষ তো কোনো দিনই ছিলাম না। নিরাপদ জায়গা ফেলে আমি তো সারা জীবন অনিরাপদ জায়গাতেই জেনেশুনে বাস করেছি।’

অন্যদিকে দ্য সেন্টার ফর ইনকোয়ারি (সিএফআই) নামক যুক্তরাষ্ট্রের একটি অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) তাঁকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নিয়ে যায়। এনজিওটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভারতীয় উপমহাদেশের মৌলবাদীদের অব্যাহত হত্যার হুমকির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে তসলিমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থাটি।

সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মুক্তচিন্তার কর্মী তসলিমা নাসরিন গত ২৭ মে নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন। তাকে সহায়তার জন্য একটি জরুরি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ জন্য সংস্থাটির দাতা ও অন্যান্য সাধারণ সদস্যের কাছে আবেদনও পাঠানো হয়েছে।

সংস্থাটি জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান ও অনন্ত বিজয়ের হত্যাকা-ের ঘটনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে আরো বলা হয়, তসলিমা নাসরিন যদি কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকতে না চান, তাহলে স্বল্প সময়ের জন্য তার নিরাপত্তা দেবে সিএফআই।

ভারতে অবস্থানকালীন সময়ের কথা বর্ণনা করে তসলিমা লেখেন, ‘আমাকে গৃহবন্দী করেছিল ভারত সরকার। ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তারপরও ফিরে গেছি ভারতে। আশ্রয় ভিক্ষে চাইনি। আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছি। গণতন্ত্রের কাছে, একটি সেকিউলার রাষ্ট্রের কাছে দাবি। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা একজন লেখক হিসেবে দাবি। দিল্লি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ। তারপরেও ছিলাম দিল্লিতে। ওই শহরটি ত্যাগ করা মানে গোটা একটি উপমহাদেশ ত্যাগ করা। আমার ভারতবাসের অনুমতি আর না পাওয়া মানে, আমার জন্য উপমহাদেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। এবারই তো নতুন সরকার এসে ভারতবাসের অনুমতিকে এক বছর থেকে কমিয়ে দুই মাসে এনেছিল। শুধু যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। নিজের আদর্শের জন্য যুদ্ধ। যেখানে বাস করতে ইচ্ছে করে, সেখানে বাস করার অধিকার চাই। পৃথিবীর সর্বত্র বাকস্বাধীনতা চাই। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করব, সে কারণে আমাকে জেল খাটতে হবে না, আমার ফাঁসি হবে না, আমার পিঠে চাবুক চালানো হবে না, আমাকে পাথর ছোড়া হবে না, আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না। এই নিশ্চয়তা চাই। শুধু আমার জন্য নয়, সবার জন্য।’

ভারতে ফেলে আসা নৈমিত্তিক জীবনের স্মৃতিচারণা করে তসলিমা লেখেন, “সেকিউলার সংগঠনটি তাদের ফান্ড রেজিংয়ের (অনুদান গ্রহণ) চিঠিটি বিলি করার পরই সমস্যা হয়েছে। বিশ্বের সব প্রচারমাধ্যমের কাছে, ‘আমি আমেরিকায় এসেছি-তার চেয়েও বড় খবর ‘আমি ভারত ছেড়েছি’। আমার ভারত ছাড়ার খবরটা যারাই ছড়িয়েছে, একটু বাড়াবাড়ি করেই ছড়িয়েছে। চিঠিতে লেখা ছিল না : আমি তল্পিতল্পা নিয়ে জন্মের মতো ভারত ছাড়ছি। ভারত ছেড়ে কোথায় যাব? এখনো তো ভারতেই পড়ে আছে আমার বাড়িভর্তি  বইখাতা, কাপড়চোপড়, অযুত-নিযুত জিনিসপত্তর, পোষা বেড়াল।”

নয়াদিল্লি থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানের বেরোনোর খবর উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘দিল্লি থেকে বেরিয়েছি ছোট একটা সুটকেসে দুটো জিন্স, দুটো শর্টস, আর কটা টি-শার্ট নিয়ে। ল্যাপটপ, আইপ্যাড তো হাতে থাকেই, সে যেখানেই যাই।’

তসলিমা নাসরিন তার নামের আগে জুড়ে দেওয়া ‘বিতর্কিত’ শব্দটির সমালোচনা করে লেখেন, ‘আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ, ‘বিতর্কিত’। শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। ‘বিতর্কিত’ বিশেষণটি আমার ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়। দুই বাংলা আমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, সব রকম চেষ্টা করেছে, যেন আমি হয়ে উঠি একটা নিষিদ্ধ নাম, একজন নিষিদ্ধ লেখক।’

তসলিমা নাসরিনের এই ভাষ্য অনুযায়ী বলা যায়, আজ এই বিতর্কিত লেখিকার জন্মদিন। এবার আমেরিকায় কেমন কাটবে তার ৫৩ তম জন্মদিন?  ১৯৬২ সালের ২৫ আগস্ট ময়মনসিংহ শহরে তসলিমা নাসরিনের জন্ম। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার পিতা রজব আলী পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। তসলিমার মাতার নাম ইদুল আরা। ১৯৭৬ সালে তিনি ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ তিনি সরকারী গ্রামীণ হাসপাতালে এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত মিটফোর্ড হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিভাগে ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বৈবাহিক জীবন : ১৯৮২ তে তসলিমা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ`র প্রেমে পড়েন এবং গোপনে বিয়ে করেন। [১৯৮৬ তে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৯০ তে সাংবাদিক ও সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের সঙ্গে বিয়ে হয় এবং ১৯৯১ সালে বিচ্ছেদ হয়।  ১৯৯১ সালে সাপ্তাহিক বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুদকে বিয়ে করেন এবং ১৯৯২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। তসলিমার কোন সন্তানাদি নেই।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, তেরো বছর বয়স থেকে তসলিমা কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তসলিমার কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে ‘শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’ নামক প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ ও ১৯৯০ সালে ‘আমার কিছু যায় আসে না’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই সময় নঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত ‘খবরের কাগজ’ সাপ্তাহিকীতে নারী অধিকার বিষয়ে লেখা শুরু করেন। তার কাব্যগ্রন্থ ও সংবাদপত্রের কলামে নারীদের প্রতি মুসলিম মৌলবাদীদের শোষণের কথা লেখায় ১৯৯০ সালে এই পত্রিকার অফিস ভাঙচুর হয়। এই সময় ‘নির্বাচিত কলাম’ প্রবন্ধসঙ্কলন প্রকাশিত হয়, যার জন্য ১৯৯২ সালে তসলিমা আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৯৩ সালের মধ্যে অতলে অন্তরীণ, বালিকার গোল্লাছুট ও বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা নামক আরো তিনটি কাব্যগ্রন্থ; যাবো না কেন? যাব ও নষ্ট মেয়ের নষ্ট গল্প নামক আরো দুইটি প্রবন্ধসঙ্কলন এবং অপরপক্ষ, শোধ, নিমন্ত্রণ ও ফেরা নামক চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।

এরপর একের পর এক বিভিন্ন লেখালেখির জন্য তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে বিতর্ক বাড়তে থাকে। সাতটি আত্মজীবনী গ্রন্থের অধিকাংশ বাংলাদেশ ও ভারত সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষিত হয়। ‘আমার মেয়েবেলা’ নামক প্রথম আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করে। ২০০২ সালে নিষিদ্ধ হয় দ্বিতীয় আত্মজীবনী ‘উতাল হাওয়া’।

২০০৩ সালে তৃতীয় আত্মজীবনী ‘ক’ বাংলাদেশ উচ্চ আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়। পশ্চিমবঙ্গে এই বইটি ‘দ্বিখন্ডিত’ নামে প্রকাশ হলে সেখানেও বইটি নিষিদ্ধ হয়। ২০০৪ সালে নিষিদ্ধ হয় ‘সেই সব অন্ধকার’।

দেশত্যাগ : ১৯৯৪ সালে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি ইসলামি ধর্মীয় আইন শরিয়া অবলুপ্তির মাধ্যমে কুরআন সংশোধনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে দেশ জুড়ে তার শাস্তির দাবীতে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে জনগণের ধর্মীয় ভাবনাকে আঘাত করার অভিযোগে মামলা রুজু হয় এবং জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। দুই মাস লুকিয়ে থাকার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তার জামিন মঞ্জুর করা হয় এবং তসলিমা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

শুরু হয় তার নির্বাসিত জীবন। বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর তিনি ১৯৯৪ সালে সুইডেনে ও ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত জার্মানিতে বসবাস করেন। ১৯৯৭ তে তিনি সুইডেন ফিরে গেলে রাজনৈতিক নির্বাসিত হিসেবে জাতিসংঘের ভ্রমণ নথি লাভ করেন। এই সময় তিনি সুইডেনের নাগরিকত্ব লাভ করেন ও সুইডিশ কর্তৃপক্ষের নিকট তার বাংলাদেশের পাসপোর্ট জমা দেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। এই সময় তার মা অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিকট দেশে ফেরার অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হলে তিনি জাতিসংঘের ভ্রমণ নথি ত্যাগ করে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের নিকট হতে তার বাংলাদেশের পাসপোর্ট ফেরত পান ও বিনা অনুমতিতে বাংলাদেশ প্রবেশ করেন। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে পুনরায় জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রুজু হলে তিনি পুনরায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সে বসবাস করেন।

২০০০ সালে তিনি ভারতে প্রবেশ করার ভিসা সংগ্রহ করতে সমর্থ হলে তিনি কলকাতা আসেন। ২০০২ সালে তসলিমার পিতা মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলে তসলিমার বাংলাদেশ প্রবেশে অনুরোধ করে ব্যর্থ হন। ২০০৪ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাকে অস্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হলে তসলিমা কলকাতা শহরে বসবাস শুরু করেন। সেখানেও বিতর্কিত লেখালেখির জন্য নানা ঘাত-প্রতিঘাতে পড়ে দিল্লিতে অবস্থান নিতে হয় তাকে।



মন্তব্য চালু নেই