লাল-সবুজের জার্সিতে মাঠ কাঁপানো টাইগারদের নেপথ্যে যারা

লাল-সবুজের জার্সিতে মাঠে নায়ক হয়ে ওঠেন মাশরাফি-সাকিব-তামিমেরা। কখনো পুরোনোদের ছাপিয়ে নায়কের আসনে বসেন নতুন কেউ। গত কদিনে যেমন নতুন নায়কে মোহিত বাংলাদেশ—মুস্তাফিজুর রহমান।
খেলাধুলা সিনেমার মতোই। মানুষ পর্দার মানুষদের যতটা চেনে, নেপথ্যের মানুষদের ততটা নয়। এ কারণে মাশরাফি-সাকিবেরা মানুষের কাছে যতটা চেনা, ততটা চেনা নন কোচিং স্টাফরা। যাঁদের কঠোর পরিশ্রমে বাংলাদেশ দল আজ হয়ে উঠছে দুর্বার, উপহার দিচ্ছে একের পর এক বিস্ময়।

বাংলাদেশ তখন ব্যর্থতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে সিরিজ হার। এরপর এশিয়া কাপেও ব্যর্থতা। সবচেয়ে বড় লজ্জা-ফতুল্লায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩২ রানে হার। ব্যর্থতার চোরাবালিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও। হংকংয়ের মতো দলের কাছে হার! ২০১৪ সালের শুরুটা হলো ভয়াবহ। ফুটবল বিশ্বকাপের ডামাডোলে জুনে ভারতের তুলনামূলক দুর্বল দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ সিরিজ হারল ২-০ ব্যবধানে। এর মধ্যে সেই ৫৮ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জা।

গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের বাজে পারফরম্যান্সে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান সরাসরিই বলেছিলেন, ‘এই টুর্নামেন্টের পর অনেক পরিবর্তন আসবে।’ বিরাট পরিবর্তন এল। পুরো কোচিং ইউনিট ঢেলে সাজানো হলো। কয় মাসের ব্যবধানে একে একে যোগ দিলেন প্রধান কোচ, বোলিং কোচ, স্পিন কোচ, ফিল্ডিং কোচ ও ট্রেনার। অবশ্য কোচিং ইউনিটে শ্রীলঙ্কানদের বেশ দাপট। এ পাঁচজনের তিনজনই শ্রীলঙ্কান।
34da77a2f81cad0906252628f2f2a017-Hathuru-singhe-imagesচন্ডিকা হাথুরুসিংহে, প্রধান কোচ
দলের ব্যর্থতায় নানা কাটাছেঁড়া তখন। অথচ এর সাত-আট মাস আগেই দল নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডেতে বাংলাওয়াশ করেছিল, টেস্ট সিরিজও ড্র করেছিল। সাফল্যের ক্ষণে হাজারো স্তুতি হলেও ব্যর্থতার সময় কেউ ওসব মনে রাখে না। এ সময় দলের দায়িত্ব নিলেন হাথুরু। দুই বছরের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিলেন গত বছরের ১০ জুন।

২৬ টেস্ট ও ৩৫ ওয়ানডে খেলা এই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল গত জুনের ভারত সিরিজ। তবে সেটি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। মূল কাজ শুরু হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। সেই সফরটা গেল ভুলে যাওয়ার মতোই। ক্রমেই জয় ভুলতে বসা দলকে ছন্দে ফেরানোর প্রথম সুযোগটা পেলেন অক্টোবর-নভেম্বরে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজে। তিন টেস্ট, পাঁচ ওয়ানডেতে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে আবারও জয়ের ধারায় ফিরল বাংলাদেশ। এরপর মিশন বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের প্রতিকূল কন্ডিশনে বাংলাদেশ কতটা সফল হবে, এমন প্রশ্ন বাতাসে। বাংলাদেশের পুঁজি তখন জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দেওয়ার আত্মবিশ্বাস। আর হাথুরুসিংহে! কেন? কোচ দীর্ঘদিন কোচিং করিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাস জীবনে। ওই কন্ডিশন তাঁর চেয়ে ভালো জানবে কে?

দুই সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ায় ঘাঁটি গাড়া বাংলাদেশ চারটি প্রস্তুতি ম্যাচে হেরে বিশ্বকাপ নিয়ে সমর্থকদের প্রত্যাশা নিয়ে গেল একেবারে তলানিতে। সেই দলটাই, হ্যাঁ, সেই বাংলাদেশ দলটাই বিশ্বকাপে এমন খেলল, সবাই চোখ কচলে তাকাতে বাধ্য হলো। সেই ছন্দে ঘরের মাঠে উড়ে গেল পাকিস্তানও। ওয়ানডেতে বাংলাওয়াশ, হারল টি-টোয়েন্টিও। এরপর খুলনা টেস্টে সেই ঐতিহাসিক ড্র। অবশ্য ঢাকা টেস্টে হেরেছিল বাংলাদেশ। তবে এক হারে নিশ্চয় দারুণ সব সাফল্য মিথ্যে হয়ে যায় না।

আর সর্বশেষ ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত দুটো জয়। বাংলাওয়াশের হাতছানি। বলতেই হয়‍—কী জাদু জানেন হাথুরু!

58a75eff06d752a0d60ecf4ab050aef9-heath_streak

হিথ স্ট্রিক, বোলিং কোচ
এক সময় মাশরাফিদের প্রতিপক্ষ ছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় এখন মাশরাফিদের বোলিং গুরু! এক সময় যে ধারালো বোলিংয়ে নাকাল করতে চাইতেন বাংলাদেশ দলকে। সে কৌশলই এখন বাতলে দেন মাশরাফিদের। ৬৫ টেস্ট ও ১৮৯ ওয়ানডে খেলা এই জিম্বাবুইয়ান দুই বছরের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসেন গত বছরের জুনে। ২০০৯ সালে কোচিংয়ে এসে কাজ করেছেন জিম্বাবুয়ের বোলিং কোচ হিসেবে। কোচ ছিলেন জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটের দল বুলাওয়ে অ্যাথলেটিকো ক্লাবেরও।

বর্তমান দলের দারুণ পারফরম্যান্সে যারপরনাই খুশি। আজ সকালে সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘আমি খুব খুশি।’ বিশেষ করে মুস্তাফিজে মুগ্ধ স্ট্রিক। বললেন, ‘মুস্তাফিজ অসাধারণ! গত দুই ম্যাচে যা করেছে এবং যেভাবে রেকর্ড গড়েছে, সত্যি অসাধারণ। কোচিং ইউনিট খুবই খুশি। তবে খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব দিতে হবে। জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর বিশ্বকাপ, দলের শক্তি কেবল বেড়েই চলেছে।’

d8705b68f6605d56914be55f6eb6100a-bcb-coach-1

রিচার্ড হ্যালসল, ফিল্ডিং কোচ
বাংলাদেশ প্রথম ফিল্ডিং কোচ পায় ২০০৯ সালে। মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, জুলিয়েন ফাউন্টেন, জেসন সুইফট, বাংলাদেশের সোহেল ইসলাম, কোরি রিচার্ডসের পর এ দায়িত্ব দেওয়া হয় রিচার্ড হ্যালসলকে। যোগ দিয়েছিলেন গত বছর বাংলাদেশের ক্যারিবিয়ান সফরেই। ওই সময় দলের সঙ্গে ছিলেন ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’। কেননা ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) চাকরিতে ছিলেন তখনো। বিশেষ অনুমতি নিয়ে এক মাসের জন্য বাংলাদেশের ফিল্ডিং কোচ হিসেবে কাজ করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। এরপর দুই বছরের জন্য দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশে আসেন ১১ অক্টোবর।

হ্যালসলের জন্ম জিম্বাবুয়েতে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকও সেখানেই মাশোনাল্যান্ডের হয়ে। পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে থিতু হয়েছেন ইংল্যান্ডে। ইংলিশ হিসেবেই পরিচিত এখন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ার থমকে গেছে মাত্র ৯ ম্যাচেই। তবে ৪৬ বছর বয়সী সাবেক এই মিডিয়াম পেসারের কোচিং প্রোফাইল বেশ সমৃদ্ধ। সাসেক্সের ফিল্ডিং কোচ ছিলেন। ২০০৭ সালে দায়িত্ব পান ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ফিল্ডিং কোচের। ২০১১ সালে দায়িত্ব নেন ইংল্যান্ডের সহকারী কোচের। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের অসুস্থতা-বিশ্রামের নানা সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন। ফ্লাওয়ারের সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের দৌড়েও ছিলেন। বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ছিলেন ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল ক্রিকেট পারফরম্যান্স সেন্টারের ফিল্ডিং কোচ।

রুয়ান কালপাগে, স্পিন কোচ
দুই মেয়াদে দীর্ঘদিন ছিলেন শ্রীলঙ্কার ফিল্ডিং কোচ। কিছুদিন ধরে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সহকারী কোচও। ২০০৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছিলেন একাডেমির হাই পারফরম্যান্স কোচ হিসেবেও। কাজেই নামটি বাংলাদেশের ক্রিকেটে বেশ আগে থেকেই পরিচিত। স্পিন ক্লিনিক পরিচালনাসহ আরও কিছু অভিজ্ঞতা মিলিয়ে কোচ হিসেবে প্রোফাইল যথেষ্ট উঁচু মানেরই। সাকিবদের ঘূর্ণিতে আরাও বিষ মেশানোর প্রক্রিয়া শেখাতে গত আগস্টে বাংলাদেশে আসেন কালপাগে।

মারিও ভিল্লাভারায়ণ, ট্রেনার
তাঁর কাজটা অবশ্য ব্যাটে-বলে নয়। তবে মাঠে লড়তে হলে ফিটনেস থাকা খুবই জরুরি। খেলোয়াড়দের ফিট থাকার নানা কৌশল-পদ্ধতি বাতলে দেন মারিও। সাধারণত সিরিজ বিরতিতে অনেক সময় খেলোয়াড়দের ফিটনেস নষ্ট হয়ে যায়। সেটিকে আবারও আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করেন মারিও। এ ছাড়া চোট কিংবা চোট কাটিয়ে খেলোয়াড়কে মাঠে ফেরানোর ব্যাপারে কাজ করেন মারিও।

একটা সময় ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ বল করতেন এই শ্রীলঙ্কান। তবে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়নি। ২০০৪-০৫ মৌসুমে খেলা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ান লেভেল-২ কোচিংয়ে সনদ পেয়েছেন। একই সঙ্গে শরীরচর্চা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রিও নিয়েছেন। বাংলাদেশে যোগ দেওয়ার আগে ট্রেনার হিসেবে কাজ করেছেন শ্রীলঙ্কান দলেও।

বাংলাদেশকে বদলে দেওয়া নেপথ্যের নায়ক হিসেবে কেবল এ পাঁচজনের নাম বলা হচ্ছে বলে তাঁরাও হয়তো আপত্তি করবেন। সবাই কাজ করেন একটা দল হিসেবেই। এ দলে রাখতে হবে আরও অনেককেই, যাঁদের ক্ষুদ্র কিংবা বড় অবদানে বাংলাদেশ দল এখন ছুটছে দুরন্ত গতিতে।



মন্তব্য চালু নেই