লন্ডনে বাঙালীদের বিয়ে বিয়ে খেলা

বিগত দশক থেকে বলা যায় হঠাৎ করেই ব্রিটেনের বাঙালি পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে নামক সামাজিক এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লন্ডনে পাড়ি জমানো কিংবা ব্রিটেনের ভিতরে অবৈধ অবস্থা থেকে উত্তরণের এক সহজ ব্যবস্থা হিসেবে হিড়িক পড়ে আসছিলো। হালের ব্রিটিশ বর্ডার এজেন্সির ব্যাপক ধরপাকড় আর হোম অফিসের ইমিগ্র্যাশন নীতিতে কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে এ ক্ষেত্রে বেশ ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এই ভাটার টান কেবল দেশ থেকে আসার ক্ষেত্রে হলেও ব্রিটেনের ভিতরে এই অবস্থা আগের চেয়ে আরো দ্বিগুণ ভাবে বেড়ে চলেছে, এই কারণে ইমিগ্র্যাশনের কঠোর অবস্থা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে।আর এই ফাকে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী আর ফড়িয়াদের পকেট ভারি করার হীন চেষ্টা লক্ষণীয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্রিটেনের বেশীর ভাগ প্রবাসীদের মধ্যে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের লোকদের বসবাস অধিকমাত্রায় হলেও ইদানীং অন্যান্য অঞ্চলের এবং স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্কিং হলিডে ভিসা আর একশ্রেণীর ঢাকার ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের খপ্পরে পড়ে অধিক পয়সা আর ভালো বেতনের আশায় ঢাকা, নোয়াখালী, রাজশাহী, রংপুর, ফরিদপুর থেকে বেশ কিছু তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, বিবাহিত, অবিবাহিত যেমন এসেছেন, একইভাবে বর্তমান সরকারের গোপালগঞ্জ কোঠার সুবাধে অনেক মন্ত্রী, সাংসদ আর কতিপয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সুবাধে হালের অনেক উঠতি তরুণ-তরুণী লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন।এদিকে স্টুডেন্ট ভিসার ও ওয়ার্কিং হলিডে এবং ওয়ার্ক পারমিট ভিসার সুবাধে যারা লন্ডনে এসে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের স্টুডেন্ট ভিসার ক্যাটাগরির নানা সংস্কারের ফলে লন্ডনে স্পন্সর কলেজ যেমন পড়েছে বিপাকে ও সরকারের তালিকাভুক্তির বাইরে, একই সাথে ইতিপূর্বে সেই সব ভিসারও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে রিনিউ না করার ফলে ঐ সব ওয়ার্কাররা পড়েছেন নানা বিপাকে। সেকারণে তারাও ছাত্র-ছাত্রীদের মতো এক প্রকারের অনিশ্চয়তা ও এক রাশ হতাশা নিয়ে দিন গুনছেন। অনেকেই দেশের বাড়িতে প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন, তাই সর্বস্ব হারিয়ে না পারছেন ফিরে যেতে, না পারছেন এদেশে থাকতে। ইমিগ্র্যাশনের কঠোর অবস্থানের কারণে এখন অনেকের আয়-রোজগারের পথও বন্ধ হতে চলেছে। আগে যেখানে গোপনে কাজ করা যেতো এখন সেই পথও বন্ধ।

এই অবস্থায় ব্রিটেনের ভিতরে এই উভয় শ্রেণী একমাত্র বৈধ বিকল্প ও নিরাপদ ব্যবস্থা হিসেবে খুঁজছেন কোন মতে যদি প্রবাসী ইমিগ্র্যান্ট পাত্র-পাত্রী ম্যানেজ করা যায়, তাহলে একটুকরো বৈধ কাগজ মিলে যায়, যা তাদের ঐ অনিশ্চিত ও বিভীষিকাময় জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারে।

০২) ব্রিটেনে থাকেন প্রবাসী বাঙালি পরিবারের অনেকেই বেশ আগ থেকেই দেশে গিয়ে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেশ থেকে পাত্র-পাত্রীদের লন্ডনে নিয়ে আসার এক ধরনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো, বিগত প্রায় এক দশক ধরেই নির্বিঘ্নে সেই সব ঘটা করেই চলে আসছিলো। গত দশকে তাই গোটা সিলেট অঞ্চল থেকে লন্ডনী ছেলে-মেয়েদের সাথে বিয়ে দিয়ে সিলেটের ছেলে-মেয়দের লন্ডন যাওয়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখা গিয়েছিলো। আর এই তীব্র প্রতিযোগিতার ফলে বিলেতের বাঙালি প্রবাসী পরিবারের বিবাহ যোগ্য ছেলে-মেয়েদের পছন্দের তালিকায় যেমন ছিলো শীর্ষে, একইভাবে এই প্রবাসী পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিয়েকে কেন্দ্র করে নানান ঘটনা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, পুলিশী মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় ও একইসাথে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের হস্তক্ষেপের কথাও ফলাও করে প্রকাশিত হতে আমরা দেখেছি।অতি সম্প্রতি এই পারিবারিক আত্মীয়তার ও প্রবাসী কন্যাকে বিয়ে না দেয়ার কারণে সিলেটের জগন্নাথপুরে এক প্রবাসী গৃহকর্তীকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে, বিবিসি ইউকে বাংলা বিভাগ এর সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

এই ধরনের বিয়েকে কেন্দ্র করে খোদ ব্রিটেনের ভিতরে ফোর্সড ম্যারিজের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত পুলিশী রিপোর্টের কারণে সরকারও বেশ নড়ে চড়ে বসে। সেকারণে ফোর্সড ম্যারেজ নিয়ে ব্রিটিশ সরকার বেশ কঠোর অবস্থানে চলে আসে। আর এর প্রেক্ষিতে আমাদের সমাজে অনেক মা বাবা ভাইকে জেলের ভাত পর্যন্ত খেতে হয়েছে, মেয়ে ফোর্সড ম্যারেজ ভিকটিম হওয়াতে তৃতীয় পক্ষের কাস্টডিতে চলে গিয়েছে, নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু জড়িত হওয়ার কারণে। সেই সাথে দেশের ভিতরে ব্রিটিশ মেয়ে কিংবা ছেলের ফোর্সড ম্যারিজের রিপোর্টের প্রেক্ষিতে মেইনষ্ট্রীম পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পরপরই স্থানীয় কনস্যুলার সেকশনের সহায়তায় বাঙালি পরিবারের সেই ভিকটিম কন্যা বা ছেলেকে সিনেমা স্টাইলে উদ্ধার করে ব্রিটেনে নিয়ে আসার রগরগা সেই সব কাহিনীও রয়েছে কমিউনিটিতে।তারপরেও ফোর্সড ম্যারেজ এবং ব্রিটেনের ভিতরে ও দেশের মধ্যে এই ধরনের সমঝোতা ও স্বার্থের বিয়ে তথা ইমিগ্র্যাশনের স্ট্যাটাসের সুবিধার বিয়ে কিন্তু থেমে নেই। আর এই সব আয়োজনকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু পরিবার ও তাদের এজেন্টদের মধ্যে পাত্র-পাত্রীদের অবস্থাভেদে মোটা অংকের লেনদেন এখন কমিউনিটিতে ওপেন সিক্রেট।

এই ধরনের বিয়ের প্রেক্ষাপট কিন্তু একটি পরিবার যখন দেশে যাওয়ার জন্য মনস্থির করে তখন লন্ডনে অবস্থানরত তাদের সোর্স বা এজেন্ট দেশে থাকা তার সোর্সের কাছে জানিয়ে দে2012-12-25-18-06-37-50d9eb2d08332-untitled-6য়। দেশে থাকা সেই সোর্স তখন বিভিন্ন বিয়ের এজেন্সি ও পাত্র-পাত্রীদের কাছে তার আগাম এই বিয়ের খবর প্রচার করতে থাকে। তার এই প্রচারে প্রধান টার্গেট থাকে হাইয়েষ্ট রেংকিংযের টাকা যে বা যারা কমিশন তাকে ও তাদের মাধ্যমে দিতে সক্ষম হন এমন টার্গেট কৃত পাত্র-পাত্রীর বায়োডাটা তখন তারা সংগ্রহে করে রাখে। ঐ পরিবারটি যখন দেশের মাটিতে পা রাখেন, এয়ার পোর্ট থেকে সেই সোর্স কিন্তু পরিবারটির পিছু নিয়ে থাকে। নানা গাল-গল্প আর লোভনীয় ফাঁদে ফেলে তার কাঙ্ক্ষিত পাত্র-পাত্রীকে উপস্থাপন করে থাকে। মজার ব্যাপার হলো এখানেও সেই সোর্স দমে থাকেনা। একের পর এক বিকল্প পাত্র-পাত্রী দেখানো হয়ে থাকে এবং সবার কাছ থেকেই টুপাইস হাতিয়ে নেয়। অবশেষে লন্ডনের সোর্সের নির্দেশে উভয় পক্ষের টাকার কমিশনের ভাগ বাটোয়ারা এবং লন্ডনী পরিবারকে এর অংশের ভাগ এমনভাবে দেয়, যেন উনাদের জন্য সে নিঃস্বার্থভাবে নিছক সোয়াবের জন্য এই বিয়ে সম্পন্ন করে দিতেছে। মা-বাবা পাত্র বা পাত্রীর বিয়ে সম্পন্নের ক্ষেত্রে খুব একটা ওদের মতামত নিতে দেননা, নিজেদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধার কথা ভেবেই। ফলে বিয়ের পর পাত্র কিংবা পাত্রীর মধ্যে বনাবনি যখন হয়না, অথবা পাত্র কিংবা পাত্রীর লন্ডনে ভালোবাসার লোক থাকার কথা যখন প্রকাশিত হয়ে পড়ে তখনো কিন্তু ঐ বিশাল টাকা ইনভেষ্টম্যান্টের কারণে উভয় পক্ষ ম্যানেজ মাষ্টারের ভূমিকায় পাত্র-পাত্রীকে মানিয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে চলেন, যেন তেন লন্ডনে গিয়ে পাসপোর্ট করার লোভনীয় আশার কথা বলে থাকেন। উপায়ন্তর না দেখে ভিকটিম তখন তাই করে চলেন। এভাবে বয়ে চলে পাসপোর্টের বিয়ে এবং জীবন।

কেইস স্টাডিঃ এক- সজল ও নির্মলা (ছদ্মনাম)

দুজনই বাংলাদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য এসেছেন ব্রিটেনে। আসার আগে লন্ডনের কলেজের চাকচিক্যময় ইন্টারনেটে এডভার্টাইজ আর লোকাল ভিসা প্রসেসিং এজেন্টের কথায় আশ্বস্ত হয়ে অনেক টাকা-কড়ি খরচ করে লন্ডনে পাড়ি জমান। লন্ডনে এসে দেখেন, যে কলেজের স্পন্সরে এসেছিলেন, সে কলেজ মূলত ব্রিটেনে ভিসা কলেজ নামে খ্যাত। ইতিমধ্যে সেই কলেজ হোম অফিসের ছাড়পত্র বাতিল হয়ে যায়, লাইসেন্সবিহিন কলেজে সজল ও নির্মলার ক্লাস আর করা উঠেনি। ভাবতে থাকেন, সেমিস্টারের যে টাকা জমা দিয়ে ভিসা নিয়েছিলেন, এখন সেই কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা গুড়ে বালি, বরং নতুন করে ভিসা স্ট্যাটাস হোম অফিস থেকে করাতে যে ঝক্কি-ঝামেলা, কলেজের নতুন করে ফি সহ ইত্যাদি খরচ কি ভাবে যোগাড় করবেন, তার উপর মাথা গোজার এখান টাই-এর জন্য সাথে নিয়ে আসা সব জমানো টাকাও শেষ, কাজ খুঁজতে গিয়ে আরেক সমস্যা ভিসা ক্যাটাগরিতে কাজের স্বীকৃতি না থাকায় সহজে কেউ কাজ দিতে চায়না, পুলিশের ধর-পাকড়ের ভয়ে। টেসকো, রেস্টুরেন্ট,ভেজিটেবল শপ ইত্যাদিতে এখন তাই ওরা হন্যে হয়ে দুমুঠো খাবারের জন্য কাজ খুঁজতে থাকে যে কোন ঘণ্টা হিসেবে।কোন মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টারে যেখানে ঠাই মিলে সেখানেই থেকে কোন মতে দিন পার করলেও রাজ্যের ভর এসে ভিড় করে আজ কোন মতে পার করা গেলো, কিন্তু কাল কি হবে। শুধু সজল ও নির্মলা নয়, তাদের মতো দেশ থেকে আসা এই রকম আরো অনেকেই এই রকম ভিসা কলেজের প্রতারণার স্বীকার করে আজ বড় অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করছেন। এক রুমের জায়গায় বন্ধু-বান্ধব ৫/৬ জন মিলে গাধাগাধি করে থাকার চেষ্টা করছেন।

এই যখন অসহনীয় অবস্থা, তখনি দেখা মিলে কিছু স্থানীয় বখাটে ও টাউট প্রকৃতির লোকের, যাদের সহায়তায় ও কতিপয় লোভী আইনজীবী ( যাদের কাজই হলো অসহায় লোকগুলোর দুরবস্থার সুযোগে টুপাইস কামানো, সবাই নন, কতিপয়)সহায়তায় ব্রিটিশ মেয়ে বা ছেলের সাথে কন্টাক্ট ম্যারিজ ও ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের সাথে বিয়ে নামক কাবিন নামার মাধ্যমে ব্রিটেনে বৈধ হয়ে থাকার একটুকরো কাগজের লোভনীয় অফারের খপ্পরে পড়ে আরো বেসামাল ও বেহাল অবস্থা। কারণ এখানেও টাকার খেলা, কন্টাক্ট ম্যারিজের জন্য, কাগজ তৈরি করার জন্য, ভিসা প্রসেসিং করার জন্য, পাত্র-পাত্রীর ডিমান্ড মিটানোর জন্য, পাত্র-পাত্রীর মা-বাবা-আত্মীয়র নামে, আইনজীবীর খরচ, হোম অফিস রিপ্রেজেন্ট করার খরচ, কতো যে খরচ, তার কোন হিসেব নেই। সজল, নির্মলা, তারেক, মাসুদ, আঁখি, রুমী, মিথিলা এই সব খরচের যোগান দিতে দিতে ক্লান্ত,তার উপর হোম অফিসের ধরপাকড়ের ভয় আর বাড়িওয়ালার তাগাদা সব মিলিয়ে উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিনযাপন। অথচ বিয়ে আর কন্টাক্ট এর ফাঁপরে আর সলিসিটরের একের পর এক বিল- সজল,মিথিলারা যে কি করে কণ পথ খুঁজে পাচ্ছেনা।এমনি অবস্থায় একদিন লুকিয়ে কাজ করা অবস্থায় টেসকো ওয়্যার হাউসে হানা দিয়ে সাথের দুই বন্ধুদের ধরে নিয়ে যায়।ভাগ্যদেবীর কৃপায় সজল ও নির্মলা সে যাত্রায় কাজে অনুপস্থিত থাকায় ধরা পড়তে হয়নি। সাথের দুই বন্ধুর ধরা পড়ায় আবারো থাকার জায়গা নতুন করে খুঁজতে রাস্তায় নামে সজলরা, কেননা পুলিশ যেকোন দিন হানা দিতে পারে এই ভয়ে।

কেইস স্টাডি: দুই- মর্তুজা (ছদ্মনাম)

দুই সন্তানের জনক মর্তুজা ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে চার বছর আগে পাড়ি জমান লন্ডনে। ওয়ার্ক পারমিটের শর্ত অনুযায়ী যে বেতন পাওয়ার কথা, লন্ডনে এসে পরিচিত সেই রেস্টুরেন্টে কাজের স্থানই হয়নি। উপরন্তু আত্মীয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দেশে থেকে খরচ ও অন্যান্য বাবদ যা পরিশোধ ইতিমধ্যে করেছিলেন, এখানে এসেও আরো অতিরিক্ত মাসিক ভিত্তিতে না দিলে ওয়ার্ক পারমিট-এর নির্ধারিত ইনস্যুরেন্স ( ন্যাশলান ইনস্যুরেন্স কার্ড ) না করার বিপত্তি হেতু নীরবে সব মেনে নেন। সেই আত্মীয়ের সুবাধে অন্যত্র কাজের সুযোগ হয়, নাম মাত্র বেতনে, তার উপর থাকা-খাওয়া বাবদ আরো কিছু কর্তন এবং ইনস্যুরেন্স ট্যাক্স বাবদ আরো কিছু মালিক কেটে রেখে দেন। এইভাবে মোটামুটি চলেই যাচ্ছিলো। বিপত্তি বাধে নির্ধারিত সময়ের পরে ওয়ার্ক পারমিট নবায়নে, হোম অফিস নিয়মানুযায়ী স্পন্সর কোম্পানির লেটার যেখানে প্রয়োজন, সেখানে ঐ আত্মীয়ের না রাজি আর নতুন কোম্পানির(রেস্টুরেন্টের) বসের অতিরিক্ত পয়সার ডিমান্ড মর্তুজা ফুলফিল করতে না পারায়, যা হবার তাই, এখন অবৈধ অবস্থায় আজ এখানে কাল ওখানে কোনভাবে লুকিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।এমনি অবস্থায় এক পরিচিত জনের সহায়তায় দেশের সব কিছু গোপন করে ব্রিটেনে স্থায়ী বসবাসের তথা বৈধ একখানা কাগজের জন্য ব্রিটিশ মেয়ে বিয়ের ব্যবস্থা, এখানেই ধার-কর্য্য ও জমানো সব সঞ্চয় উজাড় করে দালালের(পরিচিত মিডলম্যানের) হাতে দিয়ে দেন। কাবিননামা ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক হলেও বোধগম্য কারণে বাঙালি ঐ দালাল আর তার মনোনীত কন্যা এক হয়ে মর্তুজাকে পথে বসিয়ে উদাও। মর্তুজা ইলিগ্যাল হওয়াতে না পারছে পুলিশের দ্বারস্থ, না পারছে অন্য কোন ব্যবস্থা নিতে। ইতিমধ্যে কমিউনিটির লোকদের ধরে ওদের সাথে দফা-রফার ব্যবস্থা করতে চাইলেও অরো অতিরিক্ত টাকার ডিমান্ড না মিটাতে পেরে মধ্যস্থতায় কোন ফল বয়ে নিয়ে আসেনি।

কেইস স্টাডিঃ তিন

বাবা,মা জন্মগত ভাবে বাংলাদেশী,জীবিকার তাগিদে সেই বহুকাল আগে থেকে ইংল্যান্ডে এসে পাড়ি জমান,প্রথমে একক ভাবে,পরবর্তীতে আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকলে পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে স্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তুলেন।এরই মধ্যে পরিবারের কোল বেধে আসে একের পর এক সন্তান।ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকেন শনৈ,শনৈ করে,এর পর ইচ্ছে হয় সমাজসেবা ও রাজনীতি করার।কমিউনিটি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এক সময় জড়িয়ে পরেন মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনে।রাত-বিরাট ব্যবসা,আড্ডা,রাজনীতি – এই যখন উনার প্রতিদিনকার ডায়রি,তখন স্ত্রীও উনাকে পাল্লা দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সামাজিকতায়।উভয়েই বেমালুম ভুলে যান ছেলে-মেয়েদেরকে সঠিক শিক্ষা,আদর্শ, এর সামাজিক মূল্যবোধ আর প্রাচ্যের সাথে প্রতীচ্যের সামঞ্জস্য রেখে পারিবারিক জীবনযাপন করা উচিত,বরং তার বদলে সব বাঙালি নষ্ট হয়ে গেছে,অন্যকে নাস্তিক,মূর্তাদ,নানা আখ্যা ছাড়াও ইসলাম কেবল উনাদের মাঝেই,এমন ভাব-ফলশ্রুতিতে নিজ সন্তান-সন্ততি বিগড়ে গিয়ে একে বারে যখন ঘর থেকে বের হয়ে পত্রিকার হেড লাইন হলো,ফোর্সড ম্যারিজ নামের উদ্ভট তকমাটা পুরো বাংলাদেশীদের ললাটে স্থাপন করলো,তখনই টনক নড়ে,আর দুষ গিয়ে পড়ে ইসলামের নামে ধর্মীয় বিধানের উপর।কি যুক্তিহীন সস্তা প্রচারণা,নিজের ভুলের মাশুল ভিন দেশী সংস্কৃতি আর নিজ ধর্মের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার ইউরোপীয় বাংলাদেশী নামকরণ,পত্রিকার শিরোনাম ফোর্সড ম্যারিজ।আমি বলিনা যে এই রকম ফোর্সড ম্যারিজ হয়না,হয়,কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়,পারিবারিক যথাযথ মূল্যবোধের অভাব,যথোপযুক্ত শিক্ষার অভাব,আর্থিক টানা-পোড়েন,অন্ধ-গোঁড়ামি সব মিলিয়েই তা হয়ে থাকে।সেটা হয় অন্ধকার সমাজে,যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাব যেখানে,সেখানে বা সেই সমজে,কিন্তু তাই বলে এই ব্রিটেনে-সেটা একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়েই রইলো।

কেইস স্টাডিঃ চার

একই রকম পারিবারিক পরিবেশ,পরিস্থিতি,বাবা ব্যবসায়ী,মা গৃহিণী।মেয়ে ব্রিটেনের শিক্ষায় এবং পরিবেশে লালিত।বাবা-মা মেয়ের মতামতের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশ থেকে আগত সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে হাতের কাছে পেয়ে মেয়েকে বিয়ে দিলেন,কাবিন নামায় নিলেন হাজার-হাজার ক্যাশ স্টার্লিং,ঝাঁক-ঝমক করে বিয়ের আয়োজন করলেন,বিয়েও হলো,বিয়ের রাতেই মেয়ে বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজন কাউকে না জানিয়ে স্বামী বেচারাকে ফেলে উদাও।সোজা গিয়ে উঠলো ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে,বিভিন্ন এজেন্সি নড়ে-চড়ে বসলো,পুলিশকে জানানো হলো,পুলিশ তৎপর হলো,ঘটনা অনুসন্ধানে,পাশাপাশি ভিকটিমকে ব্যাপক নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হলো।এত কিছুর পরও পরিবার হার মানতে নারাজ।বাংলাদেশী মাতব্বরি স্টাইলে তখনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সদা ব্যস্ত,ততক্ষণে টেমস নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।কারণ ইতিমধ্যে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ভিকটিম কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে,গোটা বাংলাদেশের সামাজিক,কালচারাল চরিত্র উদ্ধারে ব্যাতিব্যস্ত।

কেইস স্টাডিঃ পাঁচ

মাধুরী নামের(ছদ্ম নাম)মেয়েটি ভালোবাসে তার সহপাঠী বন্ধু শেখরকে(ছদ্ম নাম)।যখন-তখন মেলামেশার ফলশ্রুতিতে মাধুরী যখন গর্ভবতী হয়ে পড়ে,মা-বাবা তখন মাধুরীর অমতে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় অন্য একজনের সাথে,তাও আবার একজন আলেম এর সাথে,যা কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয় গোটা বিষয়টি।কিন্তু মাধুরী বিয়ের রাতেই নব বরকে খুলে বলে সব কিছু,মাধুরী নব বরকে এটাও বলে তার গর্ভে তার প্রেমিকের সন্তান।নব বর তা মানতে চায়না,কারণ বাবা-মা বলে এটা ফালতু,শয়তানী কথা,বরও ভাবে এত টাকা-পয়সা খরচ করে বিয়ে করেছে,তার উপর দেশে মা-বাবা,ভাই-বোন তার উপর আশায় বসে আছে।তাই চুপ-চাপ থাকে।কিন্তু বিপত্তি বাধে মাধুরী চায় ডিএনএ টেস্ট করে এর সত্যাসত্য যাচাই করে নব বরের কাছ থেকে ও পরিবারের কাছ থেকে চলে যেতে।ফলশ্রুতিতে ডিএনএ টেস্টে রেজাল্ট আসে মাধুরী প্রেগন্যান্ট,এবং এর পিতা নববিবাহিত বর নয়,বরং প্রেমিক।ফলশ্রুতিতে বরের ঘর ত্যাগ,আর মাধুরী গিয়ে উঠে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে।

মোটামুটি এই হলো গোটা ইংল্যান্ডের ফোর্সড ম্যারিজের এই হালচিত্র,ব্যতিক্রম যে নয় তা বলবনা।

এই নিয়ে প্রায়ই ইংল্যান্ডে তুলকালাম কাণ্ড মিডিয়াতে,সব কটা পত্রিকার সংস্করণে বাংলাদেশী মেয়েদের এই ফোর্সড ম্যারিজের উপর প্রধান শিরোনাম মাজে মধ্যে এসে থাকে।এ ধরনের একটি ঘটনার বিবরণে উইয়ার সাইড উইমেন ইন নিড এর ডাইরেক্টর ক্লেয়ার ফিলিপসন বলেন,বর্তমানে বেশ কিছু বাংলাদেশী ইয়ং ওমেনরা তার সংগঠনের সাহায্য চেয়ে যোগাযোগ করার ফলে তিনি এবং তার সংগঠন এই সব মেয়েদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি আরো বলেন, weeding-photoএই সব মেয়েরা তাদের পরিবার এবং নববিবাহিত স্বামীদের দ্বারা শারীরিক,মানসিক এবং যৌন হয়রানির স্বীকার হয়েছেন।

ক্লেয়ার ফিলিপসন বলেন, এটা কোন কালচারাল ইস্যু নয়,বরং এটা হিউম্যান রাইটস এবং নারীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের অধিকারের মানবিক এবং আইনগত অধিকারের বিষয়।

তিনি আরো বলেন,এটা কোন অবস্থাতেই ধর্মীয় কিংবা গোত্র,বর্ণ বা কোন নৃতাত্ত্বিক কোন বিষয় নয়,বরং সম্পূর্ণ নারী নির্যাতনের বিষয়,যা সিরিয়াস ইস্যু।

ক্লেয়ার একটা কেইস উদাহরণ হিসেবে টেনে বলেন, ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশী একটি মেয়েকে জোর করে তার পরিবার গ্রামের এক বাংলাদেশীর সাথে বিয়ে দিতে যাচ্ছেন,যিনি দুই সপ্তাহ পর এখানে আসবেন এবং বিয়ে সম্পন্ন হবে খুব তড়িঘড়ি করে। যে কারণে ক্লেয়ার বলেন এটা কোনভাবেই গ্রহণ যোগ্য নয়,কারণ প্রত্যেকেরই রয়েছে বেসিক মানবাধিকারের আইনগত অধিকার।

ক্লেয়ার ফিলিপস এবং তার উইমেন ইন নিড সংগঠন মনে করে,তারা সম্প্রতি যে মেয়েটিকে ফোর্সড ম্যারিজের দুষ্ট গ্রহ থেকে রক্ষা করেছেন,তারা মনে করেন,এই রকম আরো অনেক বাংলাদেশী মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে,যা তাদের কাছে যথেষ্ট তথ্যভিত্তিক প্রমাণ রয়েছে।সে কারণে তারা মনে করেন বিষয়টিকে হাইলাইটেড করার দায়িত্ব সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, মিডিয়া মহলের এবং পুলিশের ও সাহায্য যথাসময়ে নেওয়ার জন্য সমাজ ও পরিবারে উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণা চালানো উচিত,নারীদের নৃগ্রহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।

তিনি বলেন,যদি কেউ এই ধরনের ফোর্সড ম্যারিজের স্বীকার হন,তবে পুলিশের সাহায্য নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন।

এ ব্যাপারে প্রটেক্টিং ভালনারেবল পিপল ডিপার্টম্যান্ট এর পক্ষে পুলিশের ডিসিআই গ্যারি হিথারিংটন বলেন, আমারা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারতেছি উদ্ভূত সমস্যা এবং যে সব ইয়ং উইম্যান তাদের পরিবার থেকে এই রকম ফোর্সড ম্যারিজের সম্মুখীন হচ্ছেন,পুরোপুরিভাবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।আমাদের রয়েছে এই ব্যাপারে দক্ষ স্পেশাল টিম,যারা এই ভয়ংকর অবস্থা এবং রিস্ক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে সাপোর্ট এন্ড এডভাইস এর পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নিবে এবং উইম্যান ইন নিড সহ সকল গ্রুপের সাথে মিলে কাজ করে ভিক্টিমদের প্রটেক্ট করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

২০০৮ সালে দ্য চয়েস হেল্প লাইন লঞ্চ করা হয় গোটা দেশের ভিকটিম নারীদের ফোর্সড ম্যারিজের বিরুদ্ধে। স্পেশাল ট্রেইন্ড স্টাফ রয়েছে টেলিফোন হেল্প লাইনে সহায়তা করার জন্য।

এইতো গেলো লিগ্যাল সাইট যারা লিগ্যালি প্রটেক্টটেড, কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে আমাদের বিশাল এক অংশ, যারা এ রকম অনেক নির্যাতনের ও অপমানকর অবস্থার শিকার। তাদেরকে কিভাবে আইনী সহায়তা দেয়া যায়, সকল সচেতন অংশের প্রতিনিধি, মিডিয়া ও সমাজ সচেতন ব্যক্তিদের ভাবতে হবে। কেননা তাদেরও রয়েছে আইনী সাহায্য পাওয়ার ও বিশ্ব মানবাধিকার ভোগের নিশ্চিত অধিকার। কিন্তু কে করবে তাদের সাহায্য ?

এই হলো আমাদের ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের লন্ডনী বিয়ের হাল চিত্র। ব্যতিক্রম যে নয় তা নয়। তবে তা সংখ্যায় একেবারে কম। আমাদের উভয় অংশের সোসাইটিতে এখন কি করে সহজে মানুষের দুর্ভোগের অবস্থার শিকারের সুযোগ নিয়ে টাকা আর পকেট ভারি করা যায়- তা এখন সমাজের প্রতিটি স্তরে ঢুকে গেছে। একেবারে অন্ধর মহল থেকে উঁচু ও বাইরে সর্বত্র এখন একই অবস্থা। উভয় অংশের গোটা সমাজের ভিতরে পচন ধরা শুরু করেছে। ইংল্যান্ডের ভিতর থেকে হউক কিংবা দেশ থেকে আসা হউক, শিক্ষিত কিংবা আধা শিক্ষিত, নারী কিংবা পুরুষ সকলেই চায়, কি করে লন্ডনে থাকার একটা বৈধ কাগজ যোগাড় করা যায়। সেজন্য হেন কোন পথ ও পন্থা, হউক তা যত অপমানজনক ও লজ্জাকর, যেন তেন উপায়ে আমার চাই- এই যখন অবস্থা হয়ে যায়- নৈতিকতা ও মানবিকতা সেখান থেকে পালিয়ে বেড়ায়। বিবেক, বুদ্ধি, বিচার আর হিতাহিতজ্ঞান আর পরোপকারিতার মহান গুণাবলী লোপ পেয়ে যায়। কারণ সকলের চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে এতো স্বার্থ আর লোভ ঢুকে পড়ে, তখন আর মানুষ তার মানবিক গুণাবলীকে হারিয়ে ফেলে।

আশার কথা, ইস্ট লন্ডনের কতিপয় সমাজ দরদী বাঙালি, আর ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত কিছু লোকের উদ্যোগে আমাদের সমাজে এইসব অতি লোভী আর অপমানজনক নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সমাজ, পরিবার ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে এখন নিরলসভাবে সম্পূর্ণ সেবামূলক ভিত্তিতে কাজ করে চলেছেন এবং সাধ্যমতো অসহায় ও দুর্ভোগের শিকার ছাত্র-ছাত্রী ও অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের যথাসাধ্য সহায়তার ও পথ নির্দেশনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েতই সামান্য। কমিউনিটির অন্যান্য ব্যক্তিত্ব ও সমাজ সচেতন সকল ও সমাজের বিভিন্ন চ্যারিটিমূলক সংগঠনগুলোকে এব্যাপারে এগিয়ে আসার উচিৎ বলে আমাদের কমিউনিটির অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।পাশাপাশি লোকান টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও এব্যাপারে সচেতনতামূলক প্রচারণায় অংশ নিয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকের অভিমত।



মন্তব্য চালু নেই