রোববার শুরু রথ উৎসব

রোববার থেকে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ও ৯দিন ব্যাপি রথমেলা উৎসব। এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ়ের শুক্লাপক্ষ দ্বিতীয় তিথিতে। আগামী ৭ জুলাই উল্টো রথযাত্রার মধ্য দিয়ে রথযাত্রা উৎসব শেষ হবে।

রথযাত্রা উপলক্ষে ৯দিন চলবে বিভিন্ন মন্দির প্রাঙ্গনে রথমেলা। রথযাত্রা ও মেলাকে ঘিরে রাজধানীর স্বামীবাগ, টিকাটুলি, ঢাকেশ্বরী মন্দির, শাঁখারী বাজারসহ বিভিন্ন মন্দির আঙ্গিনা এখন সাজ সাজ রব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রশাসন সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আগত অতিথি ও দর্শকদের জন্য নেয়া হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা।

প্রতিবারের মতো এবারও দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব অনষ্ঠিত হবে ধামরাইরের যশোমাধব মন্দিরে। ধামরাই উপজেলা সদরের কায়েতপাড়া গ্রামের শ্রী মাধব অঙ্গণে এই যশোমাধবের বিগ্রহ সাজসজ্জা থেকে শুরু করে ২৬ দিনের রথমেলার সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।

এদিকে রাজধানীতে বর্ণাঢ্য সাজে তিনটি বিশাল রথে জগন্নাথ দেব, শুভদ্রা ও বলরামের প্রতিকৃতিসহ পুরান ঢাকার স্বামীবাগের আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) থেকে শোভাযাত্রা বের হবে বেলা আড়াইটায়।

শোভাযাত্রাসহ রথ তিনটি টেনে টিকাটুলি, ইত্তেফাক মোড়, শাপলা চত্বর, প্রেসক্লাব, দোয়েল চত্বর, টিএসসি, জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে পলাশী হয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হবে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস জগন্নাথ দেব হলেন জগতের নাথ বা অধীশ্বর। তার অনুগ্রহ পেলে মানুষের মুক্তিলাভ হয়। জীবরূপে তাকে আর জন্ম নিতে হয় না। এ বিশ্বাস থেকেই রথের ওপর জগন্নাথ দেবের প্রতিমা রেখে রথযাত্রা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

রথযাত্রা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী মেলা প্রাঙ্গনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধর্মীয় আয়োজন ও মেলা শুরু হয়েছে। এছাড়া ইসকন, শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দির ও শ্রীশ্রী রাধাকান্ত জিউ মন্দির য়ৌথভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে হরিনাম সংকীর্তন, বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামানায় মহা অগ্নিযজ্ঞ, মহাপ্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, পদাবলী কীর্তন, আরতি কীর্তন, ভাগবত কথা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ, ধর্মীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও ধর্মীয় নাটক মঞ্চায়ন।

রথযাত্রা ও রথ উৎসব উপলক্ষে নয়দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে ইসকন। রোববার সকাল ৬ টায় হরিনাম সংকীর্তণ, ৮ টায় বিশ্বের মঙ্গল কামনায় মহা অগ্নিযজ্ঞ, দুপুর ১২ টায় ভোগারতি, ১ টায় আলোচনা সভা, আড়াইটায় রথযাত্রার শোভাযাত্রা, ৩ টায় ইসকনে জগন্নাথের লীলামৃত নাটিকা, সন্ধ্যা ৬ টায় সন্ধ্যারতী, রাত ৮ টায় পদাবলী কীর্তন অনুষ্ঠিত হবে।

শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতারা দেশবাসীকে রথযাত্রা উৎসবের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

রথযাত্রা উপলক্ষে ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দিরে ২৬দিন চলবে রথমেলা। গ্রামবাংলার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এ রথ উৎসব মূলত হিন্দু ধর্মীয় চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এ উৎসবের স্রোতধারা নির্দিষ্ট গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ থাকে না। উৎসবে সর্বস্তরের মানুষের সম্মেলন ঘটে।

প্রথম দিন রথকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে যশোমাধব বিগ্রহ থেকে দক্ষিণে অপর একটি মন্দিরে। সাতদিন পর আবার উল্টো রথের মাধ্যমে রথটিকে ফিরিয়ে আনা হয় যশোমাধব বিগ্রহে। হিন্দুদের মতে, রথটি এ সাতদিন তার শ্বশুর বাড়িতে কাটান।

৪৫ বছর আগে ধামরাইর রথযাত্রা ও মেলার এমন একটা রূপ ছিল যা অন্য কোন মেলায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৭১ সালের আগেও ধামরাইয়ের রথটি ছিল বিশাল তিন তলা আকৃতির। এই রথটি নির্মাণ করেন মানিকগঞ্জ জেলার বালিয়াটির জমিদার বাবুরাম।

প্রথম থেকে রথ উৎসবের দায়িত্ব পালন করে আসছিল তার মৌলিক সম্প্রদায়। বর্তমানে ধামরাই যশোমাধব মন্দির ও মেলা পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে রথ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

ধামরাই যশোমাধব মন্দির ও মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) জীবন কানাই দাস জানান, রথের প্রথম দিনে সকল জ্বরা ও বিভেদকে টেনে দক্ষিণে নিয়ে যাওয়া হয়, তার বদলে উল্টো রথের মাধ্যমে সুখ ও শান্তিকে সাথে করে ফিরে আসে রথ।

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এ কথাটির পাশাপাশি রথের দড়ি টানলে সারাবছর রোগ বালাই থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টিও বিশ্বাস করে থাকেন বলে জানান তিনি।

ধামরাই রথের ইতিহাস
ধামরাই উপজেলা সদরের কায়েতপাড়া গ্রামের শ্রী মাধব অঙ্গণে এই যশোমাধবের বিগ্রহ। বাংলার পাল বংশের শেষ রাজা যশোপাল ছিলেন এ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন প্রজাবৎসল ও ধার্মিক ছিলেন বলে রথযাত্রা ও রথমেলা পরিচালনা কমিটি সূত্র জানায়।

রাজা যশোপাল একদিন হাতিতে আরোহণ করে বেড়াতে যান ধামরাই এলাকার পাশে অন্য একটি গ্রামে। হঠাৎ রাস্তায় চলার সময় একটি মাটির ঢিবির সামনে গিয়ে হাতিটি থেমে যায়, আর চলতে চায় না। রাজার লোকেরা শত চেষ্টা করেও হাতিটি সামনে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। সেই দৃশ্য দেখে অবাক হলেন রাজা। তখন তিনি হাতি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজনকে ওই মাটির ঢিবি খনন করতে বলেন।

খনন কাজ শেষ হলে সেখানে একটি মূর্তি পাওয়া যায়। মূর্তিটি ছিল শ্রী মাধব দেবতার মূর্তি। রাজা ভক্তি করে সেটি নিয়ে এসে ধামরাই সদরে ঠাকুর বাড়ির পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ঠ পণ্ডিত শ্রী রাম জীবন রায়কে মাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার ভার দেন। রাজার নির্দেশের মাধব মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা হলে মূর্তিটির সাথে তার নামও জড়িয়ে যায়। দেবতার সঙ্গে রাজা যশোপালের নামের ‘যশো’ অংশটি মিলিয়ে বিগ্রহের নতুন নামকরণ করা হয় শ্রী শ্রী যশোমাধব।

স্বাধীনতা যুদ্ধে ধামরাইর রথটি পাকিস্তানী হানাদারদের নৃসংসতার শিকার হয়। যশোমাধবের বিগ্রহসহ মন্দিরটিকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় রথ উৎসব। পড়ে আবারো ১৯৭২ সাল থেকে একটি ছোট রথ দিয়ে উপযাপিত হয় রথ উৎসব। বর্তমান রথটি ভারত সরকারের অর্থায়নে ২০১০ সালে তৈরি করা হয়।

৪১ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ৩৭ ফুট দৈর্ঘ্য, ২০ ফুট প্রস্থ ও তিনতলা বিশিষ্ট অবকাঠামোর নতুন এ রথ লোহার পাত দিয়ে তৈরি। এরপর সেগুন কাঠের পাতলা স্তর বসিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে লোহার পাত। কাঠের উপর করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ ও দেব-দেবীর মূর্তির চিহ্ন। এটি চলে ১৫টি চাকায় ভর করে। সামনে কাঠের তৈরি দুটি তেজস্বী ঘোড়ার অস্তিত্ব রয়েছে এতে।



মন্তব্য চালু নেই