রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার প্রস্তাব ফাইলবন্দি

তিনি নারীজাগরণের অগ্রদূত। নারীর চোখে মুক্তি স্বপ্নাঞ্জন বুলিয়ে কুসংস্কারের শৃঙ্খল ভাঙার গান শুনিয়েছেন তিনি। ২০০৪ সালে বিবিসি পরিচালিত জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় ৬ নম্বরে ছিলেন এই নারীমুক্তির দিশারি। তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

আগামীকাল ৯ ডিসেম্বর তার ১৩৫তম জন্ম ও ৮৩তম মৃত্যদিন।

কিন্তু মন ভালো নেই বেগম রোকেয়ার জন্মভিটা পায়রাবন্দের মানুষের। কলকাতার সোদপুরে সমাধিস্থ এই মহীয়সী নারীর দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আনার উদ্যোগ যে বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। ছয় বছর আগে জেলা প্রশাসন রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে আনার যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মুক্ত করার উদ্যোগ নেই সরকারের তরফেও।

ফলে হতাশ-ক্ষুব্ধ রোকেয়া-অনুরাগীরা।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের সময় পাকিস্তান থেকে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের দেহাবশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জে আনার পর রংপুর অঞ্চলের মানুষ বেগম রোকেয়াকে পায়রাবন্দে এনে সমাহিত করার দাবি তোলেন। এ লক্ষ্যে গড়ে ওঠে জোরালো আন্দোলন। ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলায় রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) বি এম এনামুল হক জনগণের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

এরপর থেকে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ, বেগম রোকেয়া ফোরাম, বেগম রোকেয়া পাঠাগারসহ বিভিন্ন সংগঠন এই দাবি বাস্তবায়নে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক স্মারকলিপি দেয়। সংবাদ সম্মেলন করে রোকেয়ার অনুরাগীরা দাবিটি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেও জানায়।

পরে ২০১০ সালে রংপুরের ডিসি বি এম এনামুল হক জানান, রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পরের বছর রোকেয়া দিবসের আগে তার মরদেহ পায়রাবন্দে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। এরপর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন ও সরকার।

নারীসমাজকে কুসংস্কারের দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যেতে আলোর মশাল ধরিয়ে দেয়া

বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ এখনো ফিরে আসেনি মাতৃভূমিতে।

পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল এ প্রতিবেদককে জানান, “পায়রাবন্দে জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ ঘরে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন ডিসি সাহেব। কিন্তু সেই ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত এখন ফাইলবন্দি। মনে হয় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল গুরুত্ব দিচ্ছে না মহীয়সী রোকেয়াকে। তাই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।”

রোকেয়ার দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার এমন উদ্যোগহীনতায় আর সবার মতো হতাশ পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ একরামুল হক। তিনি বলেন, “২০০৯ সালে প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভেবেছিলাম ২০১০ সাল থেকেই রোকেয়ার সমাধিতে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারব। কিন্তু আশায় আশায় কেটে গেছে ছয় বছর। একজন মহীয়সী নারীকে নিয়ে এটা কী ধরনের প্রহসন প্রশাসন ও সরকারের!”

হতাশ বেগম রোকেয়ার স্বজনরাও। সরকারের কাছে নিজেদের জন্য কিছু চান না তারা। শুধু ফিরে পেতে চান গর্বের ধনকে। রোকেয়ার ভাইপো সোলায়মান সাবেরের স্ত্রী করিমন নেছা ও ছেলে রাশিদুল ইসলাম বলেন, “আমরা খেয়ে থাকি আর না খেয়ে থাকি, আমাদের কোনো চাওয়া নেই। সরকারের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া, বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে নিয়ে এসে তাকে সম্মান জানানো হোক।”

রোকেয়ার ভাইঝি রনজিনা সাবের মনে করেন সরকার চাইলে নারীমুক্তির আলোকবর্তিকা রোকেয়াকে ফরিয়ে আনা কঠিন কিছু নয়। “আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আন্তরিক হলেই বেগম রোকেয়ার মরদেহ পায়রাবন্দে নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার কেন টালবাহনা করছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।” বলেন তিনি।

রোকেয়ার দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব ফাইলবন্দি হয়ে থাকা রোকেয়া-অনুরাগীদের প্রতি এক ধরনের তামাশা বলে মনে করেন রোকেয়া বি এম বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রওশন আরা বেগম। বলেন, “আমরা রোকেয়া-অনুরাগীরা আর সরকারের তামাশার পাত্র হতে চাই না। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন রোকেয়া দিবস এলে ৯, ১০ ও ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই মহীয়সী নারীকে অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর সরকার ও প্রশাসন সব ভুলে যান। এর মাধ্যমে বরং রোকেয়াকে অপমান করা হচ্ছে।”

মিঠাপুকুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সরকার জানান, “কেন যে রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার দাবিটি উপেক্ষিত থাকছে, তার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।”

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য রংপুরের বর্তমান জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

নারীদের শিকল ছিঁড়ে স্বমহিমায় আলোকিত জীবন গড়ার প্রদীপ জ্বালানিয়া বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দের খোর্দ্দমুরাদপুর গ্রামে বিখ্যাত সাবের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের, মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরাণী।

১৮ বছর বয়সে খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেন সাহেবের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। ২৮ বছর বয়সে স্বামীকে হারান তিনি।

বেগম রোকেয়া ১৯১০ সালের শেষ দিকে কলকাতায় যান। এরপর দুই বাংলাতেই নারী জাগরণ ও উন্নয়নে কাজ করেন তিনি। নারীর মুক্তি আর স্বপ্ন নিয়ে লিখে গেছেন অবিরাম। তার লেখা ‘অবরোধ বাসিনী’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘অর্ধাঙ্গী’, ‘মতিচুর’ ছাড়াও অসংখ্য বই সে সময় নারী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে। আজও তা আন্দোলিত করছে বিশ্ব নারীসমাজকে।

নারীজাগরণের এই পথিকৃৎ ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে পারি জমান পরপারে। কলকাতার সোদপুরে সমাহিত করা হয় তাকে।



মন্তব্য চালু নেই