রেলে সুদিন ফেরার অপেক্ষা

যোগাযোগের জন্য সড়ক পথকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে রেলপথকে সরকার অবহেলা করেছে বলে মনে করেন পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে সড়কে বেড়েছে যানজট, বেড়েছে ভোগান্তি, বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। চার দশকের অবহেলার পরিনতিটা যে ভালো হয়নি সে বোধ এসেছে সরকারেও। তাই যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে রেলকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে কিছু কাজ, কিছু কাজ শুরু হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, কিছু আছে পরিকল্পনার পর্যায়ে।

সরকার বলছে, প্রকল্পগুলো শেষ হলে রেলের যাত্রী এবং পণ্য পরিবহণক্ষমতা বাড়বে। আর সে ক্ষেত্রে লোকসান কাটিয়ে উঠবে সংস্থাটি। আর বড় ধরনের লোকসান না হলে সেবার মানও আরও বাড়বে বলে আশা করছে সরকার। রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, ‘আমরা রেলে বিপ্লব আনতে চাই। এ জন্য কিছু কাজ হবে স্বল্পমেয়াদী, কিছু বাস্তবায়ন হবে মধ্যমেয়াদে, আর কিছু পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদী। জনগণ এক বছরের মধ্যেই এর সুফল পেতে শুরু করবে। তিনি জানান, পর্যায়ক্রমে সব রুটেই ডবল লাইন এবং ডুয়েল গেজে পরিণত করা হবে’।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে সব সময় রেল অবহেলিত ছিল। সরকার এ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে, এটা ভালো দিক। সারা পৃথিবীতেই শহরে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম রেল। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে নগরে রেলের সুবিধা বাড়াতে হবে। শহরের আশেপাশের এলাকায় রেল লাইন তৈরি করে ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর আয় বাড়াতে কনটেইনারবাহী ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

বর্তমানে ৪৪টি জেলাতে রেল লাইন আছে। আরও আটটি জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চায় সরকার। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এই কাজ শেষ হবে পাঁচ বছরের মধ্যেই। জেলাগুলো হলো মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, বরিশাল, কক্সবাজার ও নড়াইল। এসব জেলার কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। আবার কয়েকটি প্রকল্প একনেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। সেগুলোর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে আরও দুটি রুট চালুর চেষ্টা চলছে।

এই প্রকল্প শেষ হলেও আরও ছয়টি জেলায় পর্যায়ক্রমে রেল নিয়ে যেতে চায় সরকার। এগুলো হলো শেরপুর, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পটুয়াখালী ও বরগুনা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রেলকে অবহেলার অভিযোগ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা শুরু হয়। নতুন রেলপথ নির্মাণের পাশাপাশি পুরনো পথ সংস্কারের কাজ শুরু হয়। নতুন যে ২০০ কিলোমিটার রেলপথ চালু হয়েছে তার মধ্যে আছে তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রাপ্ত পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার, লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার এবং ফরিদপুর থেকে পাঁচুরিয়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার। এর বাইরে টঙ্গী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডাবল লাইন প্রকল্পও এগিয়ে গেছে অনেকটাই।

এই সময়ের মধ্যে ২০৭ কিলোমিটার রেলপথ মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হয়। এই রেলপথগুলো হলো- ঢাকা থেকে জয়দেবপুর ৮৫ কিলোমিটার, দিনাজপুর থেকে পঞ্চগড় ১৬ কিলোমিটার, পার্বতীপুর থেকে কাঞ্চন-পঞ্চগড় এবং কাঞ্চন-বিরল পর্যন্ত ১০৬ কিলোমিটার।

এছাড়া, ৭৬৫ কিলোমিটার রেলপথ পুনঃসংস্কার করা হয়। ৬৫টি নতুন সেতু নির্মাণ করা হয় এবং ৩৫৪টি পুনঃনির্মাণ করা হয়।

রেলওয়ে সুত্র জানিয়েছে, নতুন রেলপথ নির্মাণ ছাড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়া রুটও পুর্নবাসন করেছে সরকার। তারমধ্যে হলো ফরিদপুর জেলার রেললাইন। লালমনিরহাট-ভুড়িমারী। নাজিরহাট-ষোলশহর-দোহাজারী রুট পুর্নবাসন করা হয়েছে।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া-কাশিয়ানি-টুঙ্গিপাড়া প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গোপালগঞ্জ জেলা রেলওয়ের নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। ইতিমধ্যে কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া সেকশনের কাজ উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া, কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া সেকশনের কাজ চলছে।

খুলনা-মংলা রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাগেরহাট জেলা রেলওয়ের নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। খুলনা থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষা এবং ডিজাইনের কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ২৬শে মে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়।

দেশের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত রেলপথ দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সংলগ্ন গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলা রেলের নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। ১৮৩৫ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে সিঙ্গেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ সালের ৭ আগস্ট একনেকে অনুমোদিত হয়।

বর্তমানে প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সরাসরি কক্সবাজার ট্রেন সার্ভিস চালু হবে।

যশোরের নাভারন থেকে সাতক্ষীরা হয়ে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ হলে সাতক্ষীরা জেলা রেলের নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। প্রকল্পটির প্রাথমিক সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে।

দর্শনা থেকে দামুড়হুদা হয়ে মুজিবনগর এবং মেহেরপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মেহেরপুর জেলা রেলের নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। গত ২০শে মে প্রকল্পটির ডিপিপিটি পুনর্গঠন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

পদ্মা সেতুর সংযোগ প্রকল্প পর্যায়-১ (ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা) বাস্তবায়িত হলে মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলা রেলের নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য গত ২৯ জানুয়ারি চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

এছাড়া, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প পর্যায়-২ (ভাঙ্গা-নড়াইল-যশোর) বাস্তবায়িত হলে নড়াইল জেলা রেলের নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হবে। এডিবি’র অর্থায়নে প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে। বর্তমানে প্রকল্পটির কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে।

এ ছাড়া ফতুল্লা থেকে কুমিল্লার লাকসাম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। এই কাজ শেষ হলে ঢাকার সঙ্গে তিন ঘণ্টায় চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে। এই রুট চালু হলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পণ্য পরিবহণে রেলের আয় বাড়বে বহুগুণ।

রেথপথ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ফিরোজ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের অনেক পরিকল্পনাই আছে। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন হবে’।

দ্রুতগামী ইঞ্জিন ও উন্নতমানের কোচ আসবে

নতুন বেশ কিছু রুট চালুর পর ইঞ্জিন সংকটে ভুগেছে রেল। এখন ১৯৯টি ইঞ্জিন চলছে, আরও ২৫টির মেরামত কাজ চলছে। এর একটি অংশের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় সর্বোচ্চ গতিতে চলতে পারে না, পাশাপাশি জ্বালানি খরচও বেশি হয়।

এই অবস্থায় নতুন রুট চালু হলে ইঞ্জিন সংকট যেন না হয়, সে জন্য আগেভাগেই ইঞ্জিন কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ৭০টি ইঞ্জিনের দরপত্র আহ্বান করেছে সরকার। ৬০টি কোম্পানি তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। যাচাইবাছাই শেষে কার্যাদেশ দেয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই রেলের বহরে যোগ হবে এসব ইঞ্জিন। নতুন ইঞ্জিন আসলে রেলের গতি আরও বাড়বে বলেও আশা করছে রেল বিভাগ।

পাশাপাশি ২৭০টি নতুন কোচ আসবে আগামী ঈদ উল ফিতরের আগেই। এসব বগি আসলে যাত্রীবহণক্ষমতা আরও বাড়বে।

রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক জানান, নতুন বগির মধ্যে ভারত থেকে আনা হবে ১২০টি আর ইন্দোনেশিয়া থেকে আসবে ১৫০টি। জানুয়ারি থেকেই এসব বগির চালান আসতে শুরু করবে। ঢাকাটাইমস



মন্তব্য চালু নেই