রিজার্ভ চুরির দিন-তারিখ নিয়েই ধোঁয়াশা!

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির বিষয়ে এখনো কুলকিনারা না হতেই অর্থ স্থানান্তর দিনক্ষণ নিয়ে দু’রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে এ চুরি হয়েছে ৪ ফেব্রুয়ারি বা ৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ দেশি বিদেশি তদন্ত সংস্থা প্রাথমিক তদন্তে ২৪ জানুয়ারি এ লেনদেন হয়েছে বলে তথ্য দিচ্ছে। তথ্যের এ গরমিলে প্রশ্ন উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল আচরণ নিয়ে।

চুরির দিনক্ষণের গরমিলের এ তথ্যে দু’দিনের ছুটির ফাঁদের যে কথা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয় বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে ছুটি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের নিউেইয়র্ক শাখার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। কিন্তু কাজটি যদি ২৪ জানুয়ারি (রোববার) হয়ে থাকে তাহলে ছুটির ফাঁদে পড়ার কোনো অবকাশ নেই। তার মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটিকে লুকানোর পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ফিলিপাইনের পত্রিকা এনকোয়ারার ও বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোড ব্যবহার করেই এই অর্থ চুরি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম এবং সুইফট কোড কন্ট্রোলে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ৩০টি পেমেন্ট অ্যাডভাইজ পাঠায় ফিলিপাইনের স্থানীয় ব্যাংকে টাকা স্থানান্তরের জন্য। আর এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। এর মধ্যে ৫টি অ্যাডভাইজ অনার করে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। আর এই পাঁচটি অ্যাডভাইজে মোট ১০১ মিলিয়ন ডলার হ্যাকারদের হাতে চলে যায়। এর মধ্যে ২০ মিলিয়ন উদ্ধারের দাবি করলেও এখনো ৮১ মিলিয়ন রয়েছে হ্যকারদের হাতে।

এছাড়া গত ৯ মার্চ ফিলিপাইনের পত্রিকা ইনকোয়ারার জানায়, আরও ৮৭০ মিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ। এই অর্থ দেশটির ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে পাচারের চেষ্টা চলছিল। অবশ্য ঘটনাটি গত মাসের।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজম্যান্ট ও অ্যাকাউটেন্স অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ দু’টি বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত। ওই দুই বিভাগ দেখাশোনায় মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা রয়েছেন। তাদের কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য একজন নির্বাহী পরিচালকও রয়েছেন। সার্বক্ষণিক এ কাজ করার জন্য তাদের বাড়তি সুবিধাও দেয়া হয়। তাহলে ছুটির দিনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার যে যুক্তি দেয়া হচ্ছে তা অবান্তর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। তদন্তে ভেতরের বাইরের সবাইকেই সমানভাবে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হলে তা ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্ম দিতে পারে বলেও সতর্ক করেন সাবেক এ গভর্নর।

ড. সালেহউদ্দিন আরো বলেন, চুরির দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এড়াতে পারে না। এতো সিকিউর্ড জায়গায় যদি এরকম দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যসব ক্ষেত্রগুলোতে কতটা নিরাপত্তা রয়েছে তা বুঝা গেল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অ্যাকাউন্টের টাকা চুরি নিয়ে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফিলিপাইনের ইংরেজি দৈনিক দ্য ইনকোয়ারার। প্রতিবেদনে বলা হয়, চুরি যাওয়া টাকা ফিলিপাইনে ও শ্রীলংকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই সূত্র ধরে স্থানীয় গণমাধ্যমে চুরির এ ঘটনা প্রকাশের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা স্বীকার করে নেয়। পরে রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরির অভিনব এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে আলোড়ন তোলে। চুরি যাওয়া টাকার পরিমান ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮’শ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রথমে এ চুরির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ককে অভিযুক্ত করে বলেছে, সেখান থেকেই হ্যাকাররা এ টাকা নিয়ে গেছে। পরদিন ওই ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করারও হুমকি দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে এ অভিযোগের পরপরই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষ বার্তাসংস্থা রয়টারর্সকে বলেছে, এ চুরি তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার কোনো দুর্বলতা থেকে হওয়ার সুযোগ নেই। যা কিছু হয়েছে তা বাংলাদেশ থেকেই হয়েছে। তারা অর্থ স্থানান্তর করেছে প্রচলিত সব নিয়ম মেনেই।

স্মরণকালের ভয়াবহ রিজার্ভ ফান্ড লোপাটের এ ঘটনা তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টেগেশনের (এফবিআই) সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্র স্ব-উদ্যোগে এ ঘটনা তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে চায় বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এছাড়া দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে একটি ছায়া তদন্ত কমিটি।

এদিকে রিজার্ভ অ্যাকাউন্টের টাকা জালিয়াতি ফাঁস হওয়ার পরপরই আলোচিত এ ঘটনা তদন্তের জন্য তড়িঘড়ি করে ডেকে আনা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের সাবেক আইটি বিশেষজ্ঞ ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানার নেতৃত্বে একটি দলকে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড সংরক্ষণে বিদ্যমান প্রযুক্তি পরীক্ষা নীরিক্ষা করে দেখেছেন। পরে এ বিশেষজ্ঞই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা পরামর্শক কোম্পানি ফায়ারআইকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করেন, যে কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তিনি নিজেই। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব কম্পিউটারে তারই পরামর্শে গভর্নরের মৌখিক নির্দেশনায় নতুন করে অ্যান্টি ম্যালওয়্যার সফটওয়্যার ইনস্টল করা হয়। যা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে। এভাবে হুট করে একজন বিদেশিকে ডেকে এনে স্পর্শকাতর কম্পিউটারগুলোতে নতুন সফটওয়্যার ইনস্টল করা কতোট নিরাপদ না নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন তারা।

ঘটনার এক মাসেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা লোপাটে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পারার কথা জানায়নি। টাকা চুরি নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও অনিহা ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের।

স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত তদন্ত দলের একজন সদস্য তথ্য-প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের ডিরেক্টর অপারেশনসের দায়িত্বেও আছেন তিনি। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শনিবার তিনি জানান, শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। প্রাথমিক তদন্তে তিনটি কম্পিউটার শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলো থেকে ব্যালেন্স ট্রান্সফারের অ্যাডভাইস পাঠানো হয়েছিল।

তিনি বলেন, এটা পরিষ্কার যে, ঘটনাটি বাংলাদেশ থেকেই হয়েছে। চুরির এ ঘটনাকে ভয়াবহ উল্লেখ করে তানভীর হাসান বলেন, সতর্ক না হলে সামনে বড় বিপর্যয় হয়ে পারে। মনিটরিং ব্যবস্থায় দুর্বলতা কাটানো না গেলে, পুরো রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট শূন্য হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে!

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান বলেন, এ চুরিকে শুধু একটি অপরাধ হিসেবে দেখলে চলবে না। ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে নিয়ে গাইডলাইন তৈরি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি সম্ভব না হয়। এজন্য ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি উল্লেখ করে তানভীর হাসান বলেন, তারা এ কাজে ইন্টারপোলকে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ করেছেন।



মন্তব্য চালু নেই