রিকশা চালকের ছেলে সজিব

আকিদুল ইসলাম (সাদী) : রমজান মাস আল্লাহর অপার এক দান৷ এই মাসে তিনি অন্যান্য মাসের তুলনায় বান্দার গোনাহ বেশি পরিমাণ ক্ষমা করে থাকেন৷ আর মানুষ তঁার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সারাদিন সিয়াম সাধনা করে৷ অতপর মাগরিবের সময় করে ইফতারী৷ সেজন্য চলে অনেক আয়োজন৷ বাড়ি বাড়ি থেকে আলু চপ‚ পিয়াজু বরা‚ বেগুনী‚ ছোলা বুট ইত্যাদির ঘ্রাণ আসে৷ তাছাড়া অনেক মসজিদেও ইফতারীর আয়োজন করা হয়৷ সেখানেও থাকে বিভিন্ন আয়টেম৷ এলাকার লোকেরা এক একদিন এক একজন ইফতারী ব্যাবস্থা করে৷ এ নিয়মেই ইফতারীর আয়োজন হয়েছে যশোর গোলপাতা মসজিদে৷ আয়োজকরা এক একজন এক এক কাজে ব্যস্ত৷ কেউ প্লেট পরিস্কার করছে৷ কেউ আবার ইফতারীর জিনিসগুলো মসজিদে এনে রাখছে৷ সবাই-ই যার যার কাজে ব্যস্ত৷ হঠাৎ একজন বলে উঠলো‚ এই তুই ওখানে কী করিস? দাড়া দাড়া‚ দৌড় দিবি না কিন্তু! কথাগুলো বলতে বলতে সে ১৩ বছর বয়সী একটা ছেলেকে ধরে ফেললো! ধরেই মার! খুব মারা মারলো! সাথে থাকা অন্য লোকগুলোও এসে ভীর জমালো৷ কেউ ঠেকাচ্ছে না! বরং তাকে মারার জন্য উৎসাহিত করছে৷ ছেলেটা কঁাদছে আর বলছে ভাই আমারে মারেন না‚ আমি রুজা রাহিছি! কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারা ছেলেটিকে মেরেই চললো৷ তার কান্না শুনে হুজরাখানা থেকে বের হয়ে এলেন ইমাম সাহেব৷ ছেলেটি তাঁকে দেখে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো৷ না জানি কী হয়‚ হুজুর কী বলবেন! ইমাম সাহেব বললেন‚ কী হয়েছে‚ ছেলেটিকে এভাবে মারেন কেন? একজন বলে উঠলো‚ হুজুর ও চুরি করিছে৷ ওর কতো বড় কলিজা যে‚ ইফতারীর জিনিস চুরি অরে! এই বলেই কষে চড়! ছেলেটি আবার বলে উঠলো‚ ভাই আমারে মারেন না‚ আমি রুজা রাহিছি! আরেকজন বলে উঠলো‚ চোরের আবার রুজা! মার ওরে মার! ইমাম সাহেব বললেন‚ থামেন আপনারা! দেখি কী চুরি করেছে ও! তঁার কথায় একজন একটি ছোট পলেথিনের ব্যাগ এগিয়ে ধরলো৷ তিনি দেখলেন ব্যাগের মধ্যে ৬ থেকে ৭ পিচ জিলাপি৷ তা দেখে তিনি অবাক হলেন! অতপর তিনি বললেন‚ এর জন্য এতোটুকু একটি বাচ্চাকে এরকম মার! আপনাদের কি জ্ঞান-বুদ্ধি নেই? ইস! কেমন মারা মারছে দেখতো! তাঁর কথা শুনে যেন ছেলেটা একটু কিনারা পেলো৷ কিছুটা ভয়ও কমে গেলো৷ কিন্তু সে কঁেদেয় চললো৷ ইমাম সাহেব ছেলেটিকে বললেন‚ বাবা তোমার নাম কী? ছেলেটি বললো‚ সজিব! হুজুর আমারে আর মারেন না‚ ছেড়ে দেন! আমি জীবনে কোন দিন চুরি অরি নেই৷ ইমাম সাহেব তাকে অভয় দিয়ে বললেন‚ না তোমাকে কেউ আর মারবে না৷ তাঁর চোখের কোণায় যেন ছেলেটির জন্য কিছু অশ্রু জমা হলো৷ তবে তা কাউকে বুঝতে দিলেন না‚ আগেই লুকিয়ে ফেললেন৷ অতপর বললেন‚ তোমার বাসা কোথায়? সজিব বললো‚ বারান্দিপাড়া! ইমাম সাহেব বললেন‚ তোমার বাবা কি করে? সজিব বললো‚ রিকশা চালায়! তাও আবার এহনে চালায় না৷ অসুখ হয়ছে আব্বার! ইমাম সাহেব তার কথাগুলো শুনে সাথে করে নিয়ে ওজু করালেন এবং কাছে বসিয়ে ইফতারী করালেন৷ অতপর নামাজ শেষে ইমাম সাহেব এবং আরো তিন জন লোক সজিবদের বাসা বারান্দিপাড়া গেলো৷ সজিবের বাবা তাদের মুখ থেকে ছেলের চুরি করার কথা শুনে সজিবকে মার দিতে গেলেন৷ বললেন‚ এই! আমি কি তোগের এই শিয়েইছি? ইমাম সাহেব তঁাকে ঠিকিয়ে দিয়ে বললেন‚ মার অনেক হয়েছে‚ আর না! সজিবের বাবা কঁাদো কঁাদো সুরে বললেন‚ দেহেন হুজুর আমি ওগেরে অমন শিক্ষা দেই নেই! বিশ্বাস অরেন ও অমন ছেলেও না৷ এমন সময় ঘর থেকে সজিবের মা বের হয়ে এলেন৷ তিনি বললেন‚ হুজুর সত্যি কথা আমার সজিব অমন ছাওল না! ও না বুঝে ভুল অরে ফেলছে‚ ওরে মাফ অরে দেন! এর আগে ওর নামে কোন চুরি কথা শুনি নেই! এরপর পরই ঘর থেকে ভাই ভাই করতে করতে ছোট দুটি বাচ্চা বের হয়ে এলো৷ তারা সজিবকে এসে জরিয়ে ধরে বললো‚ ভাই আমাগের নাগে জিলাপি আনছো? একজন বললো আমারে আগে দিবা‚ আরেকজন বললো না আমারে আগে দিবা! কিন্তু সজিব কিছু বলছে না৷ মাটির দিকে চোখ কর শুধু জল ফেলছে৷ ইমাম সাহেব ও তাঁর সাথে আসা তিন লোকও হতবম্ভ হয়ে গেলো! বাচ্চা দুটি সজিবের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে একজন কঁাদতে কঁাদতে ঘরে চলে গেলো৷ আরেকজন মায়ের কোলে উঠে ভাইয়ের নামে বিচার দিতে লাগলো৷ মা তোমার ছাওল কয়দিন ধরে খালি মিথ্যে কছছে! জিলাপি খাওয়াবে বলে খাওয়াচ্ছে না! সজিবের মা ছোট শিশুকে কিছুই বললেন না! চোখ থেকে অশ্রু ছেড়ে দিয়ে বললেন‚ উনার কয়দিন ধরে অনেক জ্বর! কোন কাজ অরতি পারতেছে না! ছোট ছাওয়াল দুডেও জিলাপি খাওয়া বায়ন ধরছে৷ তাই সজিবরে পাঠাইছিলাম মানষের কাছে কিছু চায়ে আনতে৷ কিন্তু ও কয়দিন ধরে ফিরে আয়ছে৷ আজও এই জন্যি গিছিলো৷ যাওয়ার সময় ওগেরে কয়েগিছিলো আজগে জিলাপি খাওয়াবে৷ কিন্তু কী হয়ে গেলো! এই কথা বলেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন৷ কোলে থাকা বাচ্চাটি সজিবের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার পেন্টের পকেট ভিজে৷ সে কোল থেকে নেমে এসেই পকেটে হাত দিয়ে বের করলো ২ পিচ জিলাপি৷ তা পেয়েই সে চিৎকার করে বলে উঠলো‚ এই ভাই জিলাপি অানছেরে‚ জিলাপি আনছে৷ তার আওয়াজ পেয়ে ঘরের বাচ্চাটিও বের হয়ে এলো৷ তারা জিলাপি পেয়ে খুব খুশি! আর অন্যদিকে সজিবতো একেবারে ভয়ে চুপসে গেলো! সে বলে উঠলো হুজুর বিশ্বাস অরেন আমি এতা চুরি অরি নেই! এই দুই খেন আমার ভাগের তা‚ ওগের জন্যি রায়ে দিছিলাম! সজিবদের পরিবারের অবস্থা দেখে তার সাথে আসা ইমাম সাহেব ও অপর লোক তিনজনের চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারলো না৷ অজান্তেই তাদের দু গাল বেয়ে বারিধারা ঝরতে লাগলো! লজ্জায় তারা সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না৷ তারা তিন জন যার যার পকেট থেকে কিছু কিছু টাকা বের করে সজিবের বাবার হাতে দিলো! আর বললো‚ আমরাই ভুল করে ফেলেছি‚ দয়া করে ক্ষমা করবেন! অাপনার নিঃঅপরাধ ছেলে ধরে মেরেছি! অতপর সজিবের গা ঢলে দিয়ে বললো‚ ভাই তুইও ক্ষমা করিস! এই বলে তারা হাটা শুরু করলো৷ কেউরই কারো সাথে তাদের কথা নেই! সবার একই ভাবনা! আহারে! আমার দেশে এমন কতো পরিবার রয়েছে‚ যারা ঠিক মতো দুবেলা খাবার পায় না! কতো কষ্ট করে রোজা থাকে‚ ইফতারী করে শুধু পানি দিয়ে! আর বড়লোকেরা কতো কিছু খায়! খেতে না পেরে ডাসবিনেও ফেলায় অনেক খাবার! সে সবের অংশিকও যদি এরা পেতো তাহলে এতোটা দূর্বিশহ হতো না এদের জীবন! কবে যে হবে আমার দেশের ধনীরা সচেতন আর কবে পাবে গরিবেরা ন্যায্য অধিকার আল্লাহ জানেন! এমন আরো অনেকে কিছু ভাবছে তারা! একপর্যায় ভাবান্ত মনে তারা যার যার গন্তব্যে পৌঁছলো…….!



মন্তব্য চালু নেই