রামপাল: কিছু অভিযোগ কিছু উত্তর

আঞ্জুমান ইসলাম : বাগেরহাট জেলার রামপালে প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রশ্ন, শঙ্কা ও উদ্বেগ লক্ষ্য করছিলাম বেশ কিছুদিন থেকে। সোশ্যাল মিডিয়া ও পত্রপত্রিকাতে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কিত বেশ কিছু প্রশ্নের সদুত্তর না পাওয়া নিয়েও বেশ ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।

বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক ও সেই সঙ্গে পরিবেশবিদ হিসাবে ব্যক্তিগত তাগিদ থেকে বাংলাদেশের এনার্জি অ্যাডভাইজার ড. তৌফিক-ই-এলাহীর কাছে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাই। উনি দেখা করতে রাজি হলে মুখোমুখি বিস্তারিত আলাপ হয় এবং সেই আলাপের ভিত্তিতেই অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে এখানে।

পরবর্তীতে উদ্ভূত আরও দুতিনটি প্রশ্নের উত্তর ইমেইলের মাধ্যমে দিয়েছেন ডিরেক্টর জেনারেল অব পাওয়ার সেল মোহাম্মদ হোসেন। (প্রশ্নোত্তরে যাওয়ার আগে সবাইকে চিত্র ১ দেখে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মংলা বন্দর, সুন্দরবনের ১০ কিমি বাউন্ডারি, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লোকেশন, পশুর নদীর গতিপথ ইত্যাদি সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে নেওয়ার অনুরোধ করব।)

প্রশ্ন-১:

স্থান চূড়ান্তকরণ, জমি অধিগ্রহণ, ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর র্অথাৎ সব সিদ্ধান্ত নেয়ার পর লোক-দেখানো ইআইএ (Environmental Impact Assessment) করার যৌক্তিকতা কী?

উত্তর:

এই প্রশ্নটি সবার মনে খুব আলোড়ন তৈরি করেছে বিধায় এটির উত্তর একটু বিশদভাবে দেওয়া প্রয়োজন। নীতিমালা অনুযায়ী একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ক্রনোলজিক্যালি কোন্ স্টেপের পর কোন্ স্টেপ নিতে হবে সেখানে অন্যতম প্রধান বিবেচ্য কয়েকটি বিষয় নিম্নরূপ:

১। কী করতে চাই তা নির্ধারণ করা: খুলনা অঞ্চলের জন্য নিম্নোক্ত শর্তে একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে চাই

• সুবিধাজনক জমির প্রাপ্যতা
• নাব্যতাসহ কয়লা পরিবহণের সুবিধাদি
• প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির উৎস/যোগান
• বিদ্যুৎ সঞ্চালন সুবিধা
• নির্মাণ সামগ্রীর প্রাপ্যতা
• নিকটবর্তী বিমানবন্দরের এয়ার ফানেলে চিমনির অবস্থান না থাকা
• প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক ধর্মীয়, সামরিক স্থাপনা ইত্যাদি হতে ১০ কিমি দূরবর্তী
• অভয়ারণ্য (Sanctuaries) থেকে ২৫ কিমি দূরে থাকা (আমাদের ৭২ কিমি)
• পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধি-বিধান অনুসরণ
• নিকটবর্তী কয়লার উৎস ইত্যাদি
• ঘন জনবসতি পরিহার করা (১৮৩৪ একরে মাত্র ১৫০টি পরিবার বা প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ১২১ জন)

২। প্রকল্প অর্থাৎ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে যে সকল ধাপ অনুসরণ করতে হয় তা নিম্নরূপ:

• সাইট সিলেকশন
• ইকনমিক, এনভায়রনমেন্টাল ও সামাজিক ইমপ্যাক্ট পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের ছাড়পত্র গ্রহণ
• টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরির জন্য উপদেষ্টা (Consultant) নিয়োগ
• আন্তজার্তিক দরপত্রের মাধ্যমে EPC (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট ও কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদার নিয়োগ
• ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করা
• চুড়ান্ত ডিজাইন অনুমোদন করা, অপারেশনে যাওয়া এবং পরিচালনা ও মেইন্টেইনেন্স করা

EIA স্টাডির প্রথম ধাপ হল IEE Study (Initial Environmental Examination), এই স্টাডি শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরে দাখিল করত Location/Site Clearance পাওয়া যায়। EIA স্টাডির জন্য Location/Site Clearance এ যে সকল TOR (Terms of Reference) দেওয়া হয় তা অনুসরণপূর্বক EIA কার্যক্রম শুরু করা হয়। বিউবো সে সকল বিধি-বিধান যথাযথভাবেই পালন করে এবং প্রায় ৩ বছরে নিম্নবর্ণিত ধাপগুলো সম্পন্ন করে:

• স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ করা হয়।
• পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার (মৎস্য, বন, বন্দর) সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করা হয়।
• ১২ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে ঢাকায় সকল পরিবেশবাদী আন্দোলনকারী, সুশীল সমাজ, শিক্ষকসহ বিভিন্ন Stakeholder দের সঙ্গে গণ-আলোচনা করা হয়।
• জমির মালিকানা ভূ-গর্ভস্থ মাটি পরীক্ষায় Topography সার্ভে ইত্যাদি সম্পন্ন করা হয়।

উপরোক্ত সকল কাজ এবং বিধি-বিধান অনুসরণে EIA সম্পন্ন করা হয়। এই প্রসেস অনুসারে সঠিক সময়-ই EIA নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়েছে। সুতরাং লোক দেখানো EIA করার কথা একেবারেই সত্য নয়। EIA রিপোর্টটি পেতে এখানে ক্লিক করুন–

Final Report on Environmental Impact Assessment of 2x (500-660) MW Coal Based Thermal Power Plant

প্রশ্ন-২:

যে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি ভারতের ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১৫ কিমির মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারে না, সেই এনটিপিসি কেমন করে বাংলাদেশের সুন্দরবনের মতো একটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১৪ কিমির মধ্যে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটা বিশাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার সুযোগ পেতে পারে?

উত্তর:

এই অভিযোগটি মিথ্যা। ভারতের আইনেও বনাঞ্চলের দশ কিলোলিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা করা নিষিদ্ধ যা কিনা বাংলাদেশের আইনটির মতোই। ভারতের Ministry of Environment and Forest এর ওয়েবসাইটে ২০১১ সালের আগস্ট মাসে এ সংক্রান্ত গাইডলাইনটি প্রকাশের গেজেট নোটিফিকেশন আছে এই লিঙ্কে–

http://envfor.nic.in/assets/fc-guidlines-1.pdf

উল্লেখ্য যে এনটিপিসি ইতোমধ্যে মোট ৩১৮৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে এবং আরও ৭টি সুপার ক্রিটিক্যাল নির্মাণাধীন রয়েছে।

প্রশ্ন-৩:

EIA রিপোর্টে সুন্দরবনকে পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার বদলে ‘আবাসিক ও গ্রাম্য’ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হল কেন? কেন ক্ষতিকর সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাসের বর্তমান মাত্রা কমিয়ে দেখানো হল এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার পর বাড়তি বিষাক্ত গ্যাসকে প্রতারণার মাধ্যমে নিরাপদ সীমার মধ্যে দাবি করা হল?

উত্তর:

বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বশেষ অর্থাৎ ২০০৫ সালের বিধি-বিধান/ নির্দেশনা অনুযায়ী EIA রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। এতে শহর/আবাসিক/গ্রাম্য এলাকাভিত্তিক কোনো Classification নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধি অনুযায়ী সুন্দরবনের বাউন্ডারি সীমানা হতে ১০ কিমি পর্যন্ত ECA (Environmental Critical Area) এলাকা ঘোষিত আছে। এ ১০ কিমি ECA হতে আরও ৪ কিমি দূরত্বে অর্থাৎ ১৪ কিমি দূরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অবস্থান বিধায় কোনো বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা হয়নি। ১০ কিমি দূরত্বে জায়গাটি সন্দেহাতীতভাবেই বসবাসযোগ্য ও গ্রাম্য জায়গা হিসেবে বিবেচ্য।

প্রশ্ন-৪:

বড়পুকুরিয়ার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই যেখানে অব্যবহৃত থেকে ছাই পুকুরভর্তি হচ্ছে, ছাই উড়ে এবং ছাই ধোয়া পানি চুইয়ে মাটির নিচের পানির স্তর দূষিত করছে, সেখানে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে সাড়ে ৯ লক্ষ টন ছাইয়ের ব্যাবস্থাপনা কী হবে? সীসা, পারদ, আর্সেনিক ইত্যাদি বিষাক্ত ভারি ধাতুসম্পন্ন ছাই দিয়ে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করা হবে কোন বিবেচনায়?

উত্তর:

এটি একটি অসত্য তথ্য। ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই দ্বারা ১৪১৪ একর জমি ভরাট করা হবে না। উন্নত বিশ্বে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যেভাবে উৎপাদন করা হয় আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একই ব্যবস্থাপনায় ছাই (coal ash) হ্যান্ডল করা হবে। এতে কোনো প্রকার দূষণের আশংকা নেই। উন্নত বিশ্বের সর্বোন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলেকট্রো-স্ট্যাটিক প্রিসিপিটেটরের মাধ্যমে উৎপাদিত ছাই এর ৯৯.৯৮ ভাগ Capture করা হবে।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বছরে যে পরিমাণ ছাই এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত হবে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ছাই বাংলাদেশের সিমেন্ট কারখানাগুলোতে নিয়মিত ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এছাড়া উৎপাদিত ছাই দ্বারা ইট তৈরি, রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা যাবে বলে ছাই রাখার জন্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে না। ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রিসিপিটেটরের মাধ্যমে উৎপাদিত ছাই-এর ৯৯.৯৮ ভাগ Capture করা হবে বলে ছাই ধোয়া পানি বা অন্যান্য বিষাক্ত ধাতু দ্বারা দূষিত হওয়ার কোনো আশংকা নেই।

এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য মনে রাখতে হবে। বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ব্যাবহার করা হয়েছিল সাব-ক্রিটিক্যাল বয়লার। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে সুপার-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব যন্ত্রপাতির দ্বারা নির্মাণ করা হবে এটি। সর্বনিম্ন পরিমাণের সালফারযুক্ত উন্নতমানের কয়লা ব্যবহার করা হবে বলে দূষণের কোনো আশংকাই নেই। FGD (Flue Gas Desulphurization) ব্যবহার করা হবে এবং এতে প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষতিকর উপাদান শোষণ করা হবে। এই প্রযুক্তি সর্বাধুনিক সকল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয় এবং এতে পরিবেশের কোনো প্রকার ক্ষতির আশংকা নেই।

প্রশ্ন-৫:

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি, যানবাহন, নির্মাণকাজ, পরিবহণ, ড্রেজিং ইত্যাদি কাজে যে ব্যাপক শব্দদূষণ হবে তা থেকে সুন্দরবন রক্ষা পাবে কী করে?

উত্তর:

এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনে শব্দদূষণ বাড়ার কোনো কারণই নেই। এমনিতেই মংলা বন্দর জেটি সুন্দরবনের দশ কিলোমিটারের সীমারেখার চেয়ে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরে, সেটির আধুনিকায়নে যথেষ্ট পরিমাণ ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে/হয়েছে। পশুর নদীর নাব্যতা ধরে রাখার জন্য সেখানে এখনও ড্রেজিং চলছে।

আর নির্মাণকাজের যে শব্দের কথা বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে (১০+৪ =) ১৪ কিলোমিটার দূরত্বটি মাথায় নিয়ে ভাবার জন্যে অনুরোধ করছি। সদরঘাটে নির্মাণকাজ চললে সেই শব্দ ১৪ কিলোমিটার দূরে মিরপুরে পৌঁছানোর ব্যাপারটি কি যৌক্তিক? সেখানে সুন্দরবনের স্পর্শকাতর জায়গাগুলো ৭২ কিলোমিটার দূরে।

প্রশ্ন-৬:

যেখানে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নদীপথে সাধারণ র্কাগো স্টিমার পরিবহণেই সুন্দরবন বিপন্ন হচ্ছে এবং এ বিষয়ে তীব্র আপত্তি উঠছে, সেখানে কয়লার মতো দূষণকারী কার্গোভর্তি জাহাজ কোন বিবেচনায় সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বছরে ২৩৬ দিন করে চলাচল করবে? জাহাজের শব্দ, জাহাজ নিঃসৃত তেল, কয়লার গুড়া/টুকরো কয়লা, জাহাজ চলাচলপ্রসূত ঢেউ, সার্চলাইটের আলো ইত্যাদি থেকে সুন্দরবন রক্ষা পাবে কী করে?

উত্তর:

শত শত জাহাজ পশুর নদীর মধ্যে দিয়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মংলা বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে সপ্তাহে একটি Mother Vessel আক্রাম পয়েন্ট পর্যন্ত এবং দৈনিক একটি করে বার্জ আক্রাম পয়েন্ট হতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলাচল করবে বিধায় বাড়তি দুটি জাহাজ চলাচলে কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। তার উপর আবার মংলা বন্দরের আধুনিকায়ন ও এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্যে জাহাজ সংখ্যা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের একটি জোরালো দাবি রয়েছে।

আর কয়লা নদীর পানিতে পড়ে যে দূষণের কথা বলা হচ্ছে তা নিতান্তই অমূলক। কারণ সম্পূর্ণ আবৃত অবস্থায় কয়লা আসবে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সাউথ আফ্রিকা বা মোজাম্বিক থেকে, আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল আইন অনুসরণে হাজার হাজার মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে। সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে আসার সময় অবশ্যই বদ্ধ করে পরিবহণ করা হবে। তার উপর আছে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল সেফটি আইন। এগুলো মেনেই সকল জাহাজ পশুর নদী বেয়ে মংলা বন্দর পৌঁছায়।

সুতরাং কয়লাবাহী জাহাজে উত্তাল সমুদ্রের মধ্য দিয়ে খোলা কনটেইনারে করে কয়লা আনা হবে যা থেকে ঝপাৎ ঝপাৎ করে কয়লা পানিতে পড়ে যাবে– এটি শুধু অমূলক দুশ্চিন্তাই নয়, কল্পনাপ্রসূতও বটে।

বাকি থাকল সার্চলাইট। মংলা বন্দর পর্যন্ত এতদিন যেভাবে অন্যসব জাহাজ পৌঁছেছে ঠিক সেভাবেই কয়লাবাহী জাহাজ পৌঁছাবে। যদি তারা এতদিন সার্চলাইট বন্ধ করে চলাচল করে থাকে তাহলে কয়লাবাহী জাহাজও তা করবে।

প্রশ্ন-৭:

মেগাওয়াট পিছু বছরে ২৫০০ টন কয়লা লাগে। ১২ টন কার্বন, ৪৪ টন কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন করে। তাই ১৩২০ মেগাওয়াটের প্ল্যান্ট থেকে বছরে ১৩২০x২৫০০x৩.৭৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড বের হবে। এই কার্বন ডাই অক্সাইডের কারণে লোকাল বৃষ্টির পানির পিএইচ কতটুকু পাল্টাবে এবং সেটা সুন্দরবনের ক্রাস্টাশিয়ানস ও অন্যান্য মাইক্রোবসের জন্যে নিরাপদ কিনা। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছ মাটির স্যালিনিটি লেভেল নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্রাস্টাশিয়ানসের ওপর নির্ভরশীল।

উত্তর:

যে সমস্যা নেই তার ব্যাখ্যা দেওয়া একটু কঠিন। এসিড রেইন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কারণে হয় না। নরমাল প্রেসার এন্ড টেম্পারেচারে পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সলিউবিলিটি ১.২ গ্রাম/লিটার এবং এতে করে আমরা যে পানি খাই তার pH ৫.৫। এবার ধরা যাক কোক বা পেপসির কথা। এর pH ২.৮ বা তার কাছাকাছি। এই pH লেভেল High Pressure এ CO2 দ্রবীভূত করেও পাওয়া সম্ভব না। কারন কার্বনিক এসিডের ডিসোশিয়েশন কন্সটান্ট ই 3.6, এজন্যে কোক/ পেপসি কোম্পানি ফসফোরিক এসিড ব্যবহার করে। তাই এসিড রেইন ফ্যাক্টরটা এখানে CO2 এমিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। CO2 এমিশনের কারণে পানির pH বদলাবে না। আর তাছাড়া প্রস্তাবিত এই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) বা সালফার অক্সাইড (SOx) নির্গত হবে তা যে কোনো শহরের বাতাসের NOx ও SOx লেভেলের চেয়ে অনেক কম। তাই এসিড বৃষ্টির চিন্তা একেবারেই অমূলক।

চিত্র-২-এ রামপালের প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্ধারিত এমিশান লিমিট ও বিশ্বব্যাংক অনুমোদিত পারমিট লিমিট দেওয়া হল। মিলিয়ে দেখুন প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো লিমিট লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা।

আরও বলি। বড়পুকুরিয়া সাব-ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রায় ৭-৮ বছর চালু আছে। কিন্তু কোনো প্রকার এসিড বৃষ্টি আজ পর্যন্ত হয়নি বা হওয়ার প্রশ্নই উঠেনি। বর্তমানে রামপালের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুপার-ক্রিটিক্যাল ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় এসিড বৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা একবারেই নেই। বরং দারিদ্র্যপীড়িত এ এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে অত্র এলাকার আমূল উন্নতি সাধিত হবে, এখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পাবে। এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও সম্পদ রক্ষা পাবে।

প্রশ্ন-৮:

রামপাল প্ল্যান্টে পালভারাইজড কোল ব্যবহার করা হলে একদিক দিয়ে ছাই উৎপাদন কমবে, কিন্তু পানির ব্যবহার বাড়বে। এই মিঠা পানি পশুর নদী থেকে সংগ্রহ করা হলে নদীর উজানে লবণাক্ততা কতদূর পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশের ওপর তার প্রভাব কী হবে?

উত্তর:

EIA রিপোর্টে স্পষ্ট করে পানি-সংক্রান্ত ব্যাপারটা উল্লেখ করা হয়েছে। পানি ব্যবহার হবে ৯১৫০ m3/hr (0.04% of the dry season discharge of the Passur River), পানির টোটাল কনসাম্পশান মাত্র ৪০০০ m3/hr (0.02% of the dry season discharge of the Passur River)। এই তারতম্যে কোনো প্রভাব পড়ার চিন্তা অমূলক। তবে যদি পানি একেবারেই বরাদ্দ দিতে না হয় তাহলে বৃষ্টির মৌসুমে কৃত্রিম উপায়ে পানি স্টোর করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হবে না। পশুর নদীতে প্রতি ২৪ ঘন্টায় ২ বার জোয়ার ভাটা হয় বিধায় পানি ব্যবহারে পরিবেশের উপর কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না।

প্রশ্ন-৯:

ন্টিম টারবাইনের বাষ্প ঠাণ্ডা হওয়া গরম পানি এবং কুলিং সিস্টেমের ব্লো-ডাউন কোথায় কী তাপমাত্রায় রিলিজ করা হবে? ওই বিপুল পরিমাণ গরম পানির ইমপ্যাক্ট পরিবেশের উপর কেমন হবে?

উত্তর:

এটি প্রথম প্রশ্নের মতোই অমূলক একটি প্রশ্ন। বাংলাদেশে যত সার কারখানা থেকে শুরু করে অন্য যেসব পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে তার কোনোটাতেই এ কাজ করা হয় না। EIA রিপোর্টে স্পষ্ট বলা আছে যে, হট ওয়াটার ডিসচার্জ করা হবে না। পরিশোধন ছাড়া কোনো কঠিন তরল, বর্জ্য পানি ইত্যাদি অপরিশোধিত অবস্থায় নিঃসরণ করা হবে না।

প্রশ্ন-১০:

কয়লার বর্জ্যের সালফার পানিতে প্রবেশ করলে তার প্রভাব কেমন হবে তা পেসিমিস্টিক, রিয়্যালিস্টিক আর অপটিমিস্টিক সিনারিওতে নিরূপণ করা।

উত্তর:

এটি আরও অমূলক একটি প্রশ্ন। কারণ প্রস্তাবিত রামপাল জায়গাটিতে পৌঁছাতে মংলা বন্দর পার হয়ে আরও ৩ কিলোমিটার যেতে হয়। মংলা পোর্টে প্রতিদিন নানা রকম মালামাল ভর্তি কার্গো, জাহাজ ইত্যাদি আসে। রামপালের জন্যে সর্বোচ্চ যে বাড়তি দুটি জাহাজ আসবে তার জন্যে মংলা বন্দরে যা স্পিল মেকানিজম এখানেও সেই মেকানিজমই প্রযোজ্য।

প্রশ্ন-১১:

ছাই কীভাবে ডাম্প করা হবে এবং সম্ভাব্য সুন্দরবন বাউন্ড লোকাল উইন্ডে হাত থেকে কীভাবে রক্ষা করা হবে?

উত্তর:

রামপালকে সিলেক্ট করার পিছনে বাতাসের গতিকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি EIA রিপোর্টে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। রিপোর্টে দূষণ এড়ানোর জন্যই মূলত এই জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়েছে বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে ফ্লাই অ্যাশের কোনো সমস্যা নেই। ফ্লাই অ্যাশ হ্যান্ডলিংয়ের মেকানিজমগুলো নিয়ে EIA রিপোর্টের বিশেষজ্ঞরা অনেক কথা লিখেছেন। পড়ে নিলে ভালো হয়। তবুও ছোট্ট করে বলি, অত্যাধুনিক রামপালে যে পদ্ধতিতে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে তাতে অ্যাশ হ্যান্ডলিং মেকানিজম ব্যবহারের পরও কোনো কারণে বাতাসের গতি ঘুরে গেলেও ১৪ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবন নিরাপদ।

যেহেতু ESP (Electrostatic Precipitator) স্থাপন করা হবে, সেহেতু ৯৯.৯৮ ছাই বাতাসের সংস্পর্শে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রাপ্ত ছাই সাইলোতে রাখা হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসমূহে নিয়ে যাবে বলে জমা থাকবে না। বাংলাদেশের সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর বাৎসরিক চাহিদা ২২ লক্ষ টনেরও বেশি, কিন্তু সর্বোচ্চ ছাই উৎপাদিত হবে প্রায় ১৯ লক্ষ টন। এছাড়া ছাই দ্বারা ইট প্রস্তুত ও রাস্তা নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যায়। সুতরাং ছাইয়ের কোনো মজুদ থাকবে না।

যদি কোনো কারণে কিছু সময়ের জন্য ছাইও ডেলিভারি না হয় তবে তা Non permeable Ash Pond এ রাখা হবে যাতে কোনোভাবেই চুইয়ে না যেতে পারে। এছাড়া যে সামান্য পরিমাণ বটম Ash পাওয়া যাবে তাও পুনরায় ব্যবহার করা হবে এবং অবশিষ্ট অংশ ফাউন্ট্রিসহ অন্যান্য কারখানায় ব্যবহারের জন্য সরবরাহ দেওয়া হবে।

তার উপর সুন্দরবনের অবস্থান বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, বছরে ৯ মাস দক্ষিণ দিক হতে উত্তর দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ সুন্দরবন হতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে প্রবাহিত হয় বলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতির আশংকা নেই। শীতকালে (৩ মাস) বাতাস উত্তর দিক হতে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অর্থাৎ সুন্দরবনের পূর্বদিকে সামান্য অংশে প্রবাহিত হয় বলে সুন্দরবনের ক্ষতির আশংকা নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন-১২:

কয়লা পরিবহন রুটে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে সেটা তিন সিনারিওতে নিরূপণ করা।

উত্তর:

এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া আর ইন্দোনেশিয়া থেকে সমুদ্রপথে কয়লা আনতে বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চয়ই একটি সেফটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে যা হবে স্ট্যান্ডার্ড আন্তর্জাতিক লেভেলের। তবে হ্যাঁ, বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের টিচাররা কোল কিম্বা কোল অ্যাশ বা অন্যান্য স্পিলেজ মডেলিং-এর দায়িত্ব নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ওয়াটার সিস্টেম ও স্পিলেজ মডেলিং-এ রিসার্চ টিম তৈরি করতে হবে। এটি এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অপারেশনে যেতে যেতে স্পিলেজ মডেলিং-এর রেজাল্ট হাতে এসে যাবে।

প্রশ্ন-১৩:

অভিযোগ রয়েছে যে ভারতের এনটিপিসি-এর সঙ্গে চুক্তি সই-এর সময় বাংলাদেশের স্বার্থ কিছুই দেখা হয়নি। মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ভারত ৫০ শতাংশের মালিকানা পেয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যাবতীয় ঋণের বোঝা বাংলাদেশকে বইতে হবে আর ভারত শুধু লাভের ভাগীদার হবে।

উত্তর:

এটি সম্পূর্ণ সুষম আন্তজার্তিক একটি চুক্তি। এই প্রকল্প ব্যয়ের ৭০ শতাংশ ঋণ এবং ৩০ শতাংশ ইক্যুইটি। ৭০ শতাংশ ঋণ ও এর সুদ কেবল বাংলাদেশ পরিশোধ করবে একথা আদৌ সত্য নয়। ইনফ্যাক্ট এসব বলে ইচ্ছাকৃতভাবে এই প্রকল্প সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে মনে করছি। যে ৭০ শতাংশ ঋণ হিসাবে নেওয়া হবে তার সুদ ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লি.’ (যার মালিকানা ৫০:৫০) পরিশোধ করবে। ইক্যুইটি ৩০ শতাংশের মধ্যে ১৫ শতাংশ বাংলাদেশ এবং ১৫ শতাংশ ভারত সরকার প্রদান করবে।

চূড়ান্ত মূল্যায়ন:

সারা বিশ্বে ৬০ শতাংশের অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় কয়লা দ্বারা। আমেরিকা, চীন, ভারত যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ, ৮০ শতাংশ ও ৬৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়লা দ্বারা করে আসছে যেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২.৫ শতাংশ।

সুন্দরবনকে প্রটেক্ট করার নামে এই প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘিরে যেসব জটিলতা তৈরি করা হচ্ছে তা আমার কাছে এখন পর্যন্ত ভিত্তিহীন। উপরে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো এমন যে তাতে রামপালে না হয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি লবণচড়াতে হয় তাতে কিছুই এসে যাবে না। কারণ সেই একই নৌপথ ব্যবহার হবে, সেই একই মংলা বন্দর ব্যবহার হবে, সেই একই এমিশান লিমিট প্রযোজ্য থাকবে ফ্লু গ্যাসের জন্যে।

আসলে “State of the art” টেকনিক ব্যবহার করলে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের বাইরে কোথায় এই প্ল্যান্ট করা হল সেটা কোনো ব্যাপার নয় যদি কিনা প্ল্যান্ট অপারেশনের সময় সমস্ত নিয়ম ও নীতি মেনে চলা হয়।

পরিশেষে বলা যায়, আন্তজার্তিক পরিবেশ অধিদপ্তরের সকল বিধি-বিধান মেনেই এবং সুন্দরবনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ও তার রক্ষার সকল দিক আমলে নিয়েই এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

যারা এর বিরোধিতা করছেন তাদের অনুরোধ করব EIA তে উল্লেখিত Mitigation, Preventives Measure অধ্যায়টি পড়তে। এছাড়াও যদি আপনারা মনে করেন সুরক্ষার বিষয়ে আরও কিছু করা দরকার তবে লিখিতভাবে পরামর্শ দিলে কর্তৃপক্ষ উপকৃত হবে।



মন্তব্য চালু নেই