রাত হলেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে মহাসড়ক!

রাত হলেই বগুড়ার মহাসড়কগুলো হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। টানা অবরোধে চোরাগোপ্তা হামলায় এ পর্যন্ত ২০টি মালবোঝাই ট্রাকে আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে শতাধিক গাড়ি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন দুজন। পুলিশ সদস্যসহ ২০ জন আহত হয়েছেন।

ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এসব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে অবরোধকারীরা। নাশকতায় সরাসরি জড়িত কাউকে এখনও আটক করতে পারেনি পুলিশ।

ফলে পণ্যবাহী যানবাহন পুলিশ-বিজিবির পাহারায় চলাচল করলেও রক্ষা পাচ্ছে না নাশকতার হাত থেকে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহাসড়কে যানবাহনের গতিরোধ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ত্রিফলা। লোহার তৈরি তিন দ-বিশিষ্ট ত্রিভূজ আকৃতির এই আজব কাঁটা চালকদের পক্ষে রাতের আঁধারে দেখা সম্ভব নয়। এতে পুলিশের শক্তিশালী টহল গাড়িও অকেজো হয়ে পড়ছে। ফলে মহাসড়কে নাশকতা দিনে দিনে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

এদিকে গত দুই মাস ধরে চলা পুলিশের বিশেষ অভিযানে সরাসরি নাশকতায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।

জেলা পুলিশের মিডিয়া সেল থেকে জানা গেছে, গত দুই মাসে পুলিশের বিশেষ অভিযানে নাশকতা মামলার দুই হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের সবাই জামায়াত-বিএনপির নেতা-কর্মী। তারপরও নাশকতা থামছে না। রাতে মহাসড়কে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানান, অবরোধকারীরা চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। ফলে তাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য জনসাধারণের সহায়তা দরকার বলে তিনি মনে করেন।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সদরের রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের নূনগোলা এলাকায় ফার্নিচারবোঝাই একটি ট্রাকে পেট্রোল বোমা হামলায় চালক, হেলপার ও ব্যবসায়ী গুরুতর আহত হন। এদের মধ্যে হেলপার আব্দুর রহিম ঢাকার একটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই রাতেই শাহাজানপুরে মহাসড়কে একটি আলুবোঝাই ট্রাকে আগুন দেওয়া হয়।

অবরোধের প্রথম দিকে শিবগঞ্জে পিকেটারের ছোড়া ইটের আঘাতে নাটোরের এক ট্রাকচালকের মৃত্যু ঘটে।

২১ জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যার পর বগুড়ায় দুটি ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়াও রাত ১০টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরিত ককটেলের স্পিøন্টারের আঘাতে আহত হন কমপক্ষে ১০ জন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

১৯ জানুয়ারি সোমবার রাতে মহাসড়কে পাঁচটি ট্রাক ও সিএনজিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এগুলোর মধ্যে মহাসড়কের শহরতলীর চারমাথা-ঝোপগাড়ী এলাকায় দুটি মালবাহী ট্রাকে আগুন, শাজাহানপুরের ফটকি ব্রিজ এলাকায় একটি সবজিবাহী ট্রাকে আগুন, এরুলীয়া এলাকায় একটি এবং শেরপুর উপজেলার ঘোগা সেতুর ওপর একটি ট্রাকে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে কয়েটি সিএনজিসহ অর্ধশতাধিক যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

১৭ জানুয়ারি শনিবার প্রথম বাইপাস মহাসড়কের ঝোপগাড়ী এলাকায় একটি সুজি ও চিনি বহনকারী ট্রাকে আগুন দেয় পিকেটাররা।

৪ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে শহরতলীর বারপুর এলাকায় একটি আলুবোঝাই ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছোড়ে এবং আগুন দেয় অবরোধকারীরা। এতে হেলপার লাফিয়ে রক্ষা পেলেও চালক পটল মিয়া অগ্নিদগ্ধ হন। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (শজিমেক) তার চিকিৎসা চলছে।

৬ জানুয়ারি রাতে শহরতলীর বারপুর এবং গোকুলে কাঠবোঝাই ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় অবরোধকারীরা। ওই রাতে মহাস্থানের নগরকান্দিতে গাইবান্ধা থেকে ইজতেমাগামী সাফা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি কোচে (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-০৬৪৭) ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে অবরোধকারীরা। এতে কাঁচ ভেঙে চালকসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। একই রাতে শাজাহানপুরের টেঙ্গামাগুর এলাকায় মহাসড়কে মুরগীর খাদ্যবোঝাই একটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় পিকেটাররা।

৯ জানুয়ারি রাতে শহরতলীর বারপুরে একটি ট্রাক, গোকুলে একটি কাভার্ড ভ্যান ও শহরের কৈগাড়ী এলাকায় একটি থ্রি-হুইলারে (সিএনজি) আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

১০ জানুয়ারি রাতে শেপুরের মহিপুর ও ছোনকায় আলুবোঝাই দুটি ট্রাকে আগুন দেওয়া হয়। ওই রাতে নন্দীগ্রাম উপজেলার দামগড়া এলাকায় মহাসড়কে গাছ ফেলে জাসদ নেতা শাহীন ও রেজাকে মারপিটট করে টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। শাহীনের প্রাইভেটকারও পুড়িয়ে দেয় তারা।

১১ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে মহাস্থান এলাকায় ট্রাকে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই রাতে শহরতলীর চারামাথা এলাকায় পিকেটারদের ইটের আঘাতে ট্রাকে থাকা নার্গিস (৩০) নামের এক গৃহবধূ আহত হন। সন্ধ্যায় ভবেরবাজার এলাকায় পিকেটারদের ভয়ে দ্রুত চালাতে গিয়ে ট্রাক উল্টে আহত হেরপার মিলন মিয়া। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

একই রাতে বিশ্ব ইজতেমর ডিউটি শেষে পুলিশের একটি পিকআপ রংপুর ফিরছিল। বগুড়ার গোকুলে পুলিশের ওই পিকআপটির চাকায় ত্রিফলা বিদ্ধ হয়। ফলে আটকা পড়ে গাড়িটি। এ সময় অবরোধকারীরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে পিকআপটি ভাঙচুর করে। অবরোধকারীদের ইটপাটকেলের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। আহতদের মধ্যে জোবায়ের নামের এক পুলিশ সদস্যকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অর্ধশতাধিক ত্রিফলা উদ্ধার করে। এ সময় পুলিশের দুটিসহ ১০টি গাড়ি ত্রিফলা বিদ্ধ হয়ে অকেজো হয়।

জেলা পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক পিপিএম জানান, মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন চলাচল করে। মাঝেমধ্যে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরের ঘটনায় লিপ্ত হচ্ছে অবরোধকারীরা। তবে ঘটনার পরপরই তাদের আটক করতে সক্ষম হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।



মন্তব্য চালু নেই