রাণীনগরে থাই জাতের পিয়ারা চাষ করে স্বাবলম্বী শফিকুল

কাজী আনিছুর রহমান, রাণীনগর (নওগাঁ) : ধান উৎপাদনের জেলা হিসাবে খ্যাত নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় কৃষি ফসলের পাশাপাশি মুখরোচক বাংলা আপেল খ্যাত ভিটামিন সি’তে ভরপুর রসালো ফল থাই জাতের পিয়ারা চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুড়ালেন উপজেলার শিয়ালা গ্রামের মৃত সায়েদার রহমানের ছেলে শিক্ষিত ছেলে একেএম ষফিকুল ইসলাম রবু (৪৮)।

শফিকুলের পিয়ারা বাগানে গেলে চোখ ফিরাতে মন চায়না। ছোট-বড় সবুজ গোল আকৃতির পিয়ারা প্রায় প্রতিটি গাছে নিজ থেকে কান্ড পর্যন্ত ধরে আছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই আকৃতিতে বড় হয়ে ওজন বাড়ার সাথে সাথে মূল্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুখরোচক ফল হিসাবে স্থানীয় বাজারসহ দেশে বিদেশে সর্বত্র এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পিয়ারা চাষের শুরুতে কৃষক শফিকুল ভাল করতে না পারলেও হাল ছেড়ে না দিয়ে এর প্রসার বৃদ্ধি লক্ষ্যে বেশী লাভের আশায় বাণিজ্যিক ভাবে পিয়ারা চাষ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ১৯৮৯ সালে ডিগ্রি পরীক্ষায় উর্ত্তীন্ন হতে না পেরে কিছুটা হতাশায় পরিবারের লোকজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রথমে তিনি পেঁপে, করলা, ঢেঁড়শের আবাদ শুরু করলেও আবহাওয়া অনূকূলে না থাকায় স্থানীয় কৃষি বিভাগের প্রত্যক্ষ পরামর্শ ও সহযোগীতার অভাবে বাণিজ্যিকভাবে সে সফল হতে না পেরে ২০১৩ সালে তার বড় ভাই প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামের পরামর্শে তাদের পৈত্রিক ২ বিঘা জমিতে প্রায় ২লক্ষ ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে মাটি ভরাট করে পিয়ারাসহ অন্যান্য শাক-সবজি চাষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সবজি চাষে কোন রকমে পুঁজি ফেরত পেলেও পিয়ারা চাষে ভাল ফলন হওয়ায় এক বছরে আশানুরুপ লাভ করে পিয়ারা চাষে শফিকুল এখন স্ববলম্বী।

জানা গেছে, উপজেলার একডালা ইউনিয়নের শিয়ালা গ্রামের মৃত সায়েদার রহমানের তৃতীয় ছেলে শিক্ষিত একেএম শফিকুল ইসলাম রবু। পড়ালেখা পুরোপুরি শেষ করতে না পারলেও ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু সংসার জীবনে বেকারত্বের অভিশাপের বেড়াজালে কঠিরন এক মহুর্তে নিজ ইচ্ছায় ৯৬ সালে প্রতারক এক আদম ব্যাপারীর খপ্পরে পড়ে মালোয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রায় ৬ মাস ধরে মানব পাচার দালাল চক্রের প্রভাবশালী সদস্যরা থাইলান্ডের জঙ্গলে আটকে রেখে পুনরায় অতিরিক্ত টাকার দাবি করলে সেটাও পরিশোধ করে কোন ভাবে মালোয়েশিয়ায় পৌঁছলেও অবৈধ অনুপ্রবেশের কারনে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে আতœগোপনে থাকা অবস্থায় অনেক চেষ্টা করে উপযুক্ত কাজকর্ম হাতে না পেয়ে আর্থিক তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা তার ভাগ্যে জোটেনি। খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টের এক পর্যায়ে দেড় বছরের মাথায় দেশে ফিরতে হয়েছে তার। এরপর সংসার জীবনে আবারও অন্ধকার। পারিবারিক পরামর্শে ২০০০ সালের দিকে নিজের দুটি পুকুর ও অন্যের দুটি পুকুর ১ লক্ষ টাকায় লীজ নিয়ে মাছ চাষের মধ্য দিয়ে ভাগ্য বদলের চেষ্টায় মাছ চাষসহ পুকুরের পার্শ্বের জমিতে পেঁপে , ঢেঁড়শ, করলা নানা জাতের শাকসবজি ও বগুড়ায় প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবসা শুরু করে। প্রায় এক দশক ধরে লাভ-লছের মধ্যে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ব্যবসা চললেও বিধির বাম সেগুলোতে সফলতা না পেয়ে উল্টো তার বড় অংকের লোকসান গুনতে হয়। জীবনের সফলতা না পেলেও হতাশায় তাকে দেবে রাখতে পারেনি।

শফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৩ সালে আমার বড় ভাই সাইফুলল ইসলামের পরামর্শে পুন:রায় জীবনের শেষ ঝুঁকি হিসাবে পৈত্রিক ২ বিঘা জমিতে প্রায় ২ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে মাটি ভরাট করে ২০১৫ সালে অর্ধেক জমিতে পিয়ারা চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করি। সেই লক্ষে প্রথমে বগুড়া জেলার মাহাস্থান থেকে উন্নত মানের থাই জাতের ১৪৮টি ৩০ টাকা দরে পিয়ারার চারা কিনে জমিতে লাগাই। গাছের বয়স দুই মাসের মাথায় ফুল আসলে বাগানে নিজেসহ মাঝেমধ্যে দিন হাজিরায় ৩/৪ জন শ্রমিক নিয়ে নিবিড় পরিচর্যা শুরু করেন। বৃষ্টি বাদল এবং নানা রোগবালায়ের কারণে স্থানীয় কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কারিগরি পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করার ফলে বাগানের অবস্থা উন্নতি হওয়ায় গাছে ডালে ডালে সবুজ রং এর পিয়ারা শোভা পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিমণ পিয়ারা প্রায় ২ হাজার টাকা মণে জমি থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এ বছর প্রথম বিক্রিতেই ভাল মুনাফার আশা করছেন। সারা বছর এই বাগান থেকে পর্যায়ক্রমে পিয়ারা বিক্রয় হবে। তখন মুনাফা বেশি আর খরচ কমিয়ে আসবে। কোন ফরমালিন কিংবা মেডিসিন প্রয়োগ ছাড়াই তার বাগানে উৎপাদিত থাই জাতের পিয়ারা গাছ থেকে নামানোর পর প্রায় ৫/৬ দিন থাকলেও ভিতরে ও বাহিরে কোন পঁচন ধরে না। খেতে খুব সুস্বাদু মিষ্টি হওয়ায় এর চাহিদা বিদেশেও রয়েছে। দেশি পিয়ারার চেয়ে বেশি গুনাগুন সম্পূর্ণ হওয়ায় স্থানীয় জাতের চেয়ে এর দাম প্রায় তিন গুন। পিয়ারা ছাড়াও লেবু, বেদেনা, ঢেঁড়শসহ বেশকিছু শাকসবজি চাষ করেন তিনি।

রাণীনগর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ এসএম গোলাম সারওয়ার জানান, শফিকুলের পিয়ারা বাগান খুব ভাল হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে সার্বক্ষনিক পরামর্শ দৌয়ার কারণে যথা সময়ে ভাল পরিচর্চা করার ফলে রোগ-বালাই কম হওয়ায় খাই জাতের পিয়ারা চাষে ভাল ফলন হবে এবং ভাল মুনাঢা পেয়ে ধীরে ধীরে সে স্বাবলম্বী হবে।



মন্তব্য চালু নেই