রাজনৈতিক নানা সমীকরণে ‘জাতীয় ঐক্য’

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী ‘জাতীয় ঐক্য’ নিয়ে রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ। গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সন্ত্রাস বিরোধী জাতীয় ঐক্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে ক্ষমতাসীনরা। বিশেষ করে ‘জাতীয় ঐক্য ইতোমধ্যে হয়ে গেছে’ মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্য হতাশ করে বিএনপিকে, কিন্তু তারপরেও হাল ছাড়ছে না দলটি। খবর বাংলামেইলের।

বিএনপি বলছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাড়া না দিলে শেষ পর্যন্ত তাদের ছাড়াই জাতীয় ঐক্য হবে। এ ক্ষেত্রে ‘প্রতিবন্ধক’ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে ‘কৌশলে’ ছাড়ার বিষয়টিও সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে দলটির।

এদিকে, ‘জাতীয় ঐক্য’ নিয়ে সরকারের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ায় বিএনপি এখন সন্ত্রাস বিরোধী ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গঠনের পথে এগুচ্ছে। ২০ দলীয় জোট এবং ১৪ দলীয় জোটের বা্ইরে অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও প্রগতিশীল দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা প্লাটফর্ম গঠন করতে চায় বিএনপি। তবে এ ক্ষেত্রে ২০ দলকে রেখে শুধু জামায়াতকেও বাদ দেয়া হতে পারে।

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে জামায়াতকে বাইরে রাখতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিএনপি ঘরানার দুইজন বুদ্ধিজীবী এমন পরামর্শ দেন। জামায়াতকে নিয়ে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে থাকা খালেদা জিয়া তাদের এ প্রস্তাবে ‘ইতিবাচক সায়’ দিয়েছেন বলে বিএনপি সূত্র জানায়। খুব শিগগিরই (চলতি সপ্তাহে) এই দলগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে চায়ের দাওয়াত জানাবেন খালেদা জিয়া।

সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গঠনে ওই দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে বিএনপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ এবং দলটির রাজনীতির পরামর্শক ও সমালোচক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ করছেন। এর অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকেকালে তারা মুঠোফোনে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের আলাপ করিয়ে দেন বলে জানা যায়।

বিএনপির পক্ষ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানকে এই দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী, দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই দুইনেতা ইতোমধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তবে দেশের বাইরে থাকায় ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কথা হয়নি বিএনপির।

এছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দৌজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ, কমরেড সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, কমরেড খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সঙ্গেও কথা বলবে বিএনপি।

তবে জাতীয় ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে বিএনপিকে সবদিক থেকেই জামায়াত ত্যাগের ব্যাপারে বলা হয়েছে। ওই দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে ‘জামায়াত যে প্রতিবন্ধকতা’ গত ১৩ জুলাই অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের সর্বশেষ বৈঠকে তা স্বীকার করেন স্বয়ং খালেদা জিয়াও।

জাতীয় ঐক্য গঠন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেছেন, ‘জামায়াতের সাথে বেহেশতে যেতেও আমার আপত্তি আছে।’

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শর্তহীনভাবে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা ইতোমধ্যে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়াও পেয়েছি। অন্যদের সঙ্গেও কথা বলব।’

জাতীয় ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াত কোনো প্রতিবন্ধকতা কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, কারো পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।’

নোমান দাবি করে বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা সাড়া দিক বা না দিক, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য হবেই।’

এদিকে, এই জাতীয় ঐক্যকে সামনে রেখে আগামী ২ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে দেশের রাজনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সূত্র জানায়, ওই মতবিনিময় সভায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের ভেতরে ও বাইরে অবস্থানরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও প্রগতিশীল দলগুলোকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ২০ দলের মধ্যে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদের (বীরবিক্রম) নেতৃত্বাধীন এলডিপি, ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ’র বিজেপি, শফিউল আলম প্রধানের জাগপা, মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতিকের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও জেবেল রহমান গাণির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়া আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও। তবে অলি আহমদ ও পার্থ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বীরপ্রতিক বলেন, ‘বিএনপির দুই নেতা অনানুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেলে বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘দেশ ও জাতির বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। আমরাও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে আগামী ২ আগস্ট এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানেই জাতীয় ও পেশাজীবী নেতাদের পরামর্শ নিয়ে ঐক্যের কার্যপ্রণালী ঠিক করা হবে।’

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর আমন্ত্রণ পাবার বিষয়টি স্বীকার করে ২০ দলীয় জোট শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি বলেন, তিনি (বঙ্গবীর) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের এক জীবন্ত কিংবদন্তী। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে করণীয় নির্ধারণে তিনি যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তাতে সাড়া দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, জঙ্গিবাদ কোনো একক দল কিংবা গোষ্ঠীর সমস্যা নয়, এটি জাতীয় সমস্যা। তাই জাতির এই সমস্যাকে ঐক্যবদ্ধভাবেই মোকাবেলা করা উচিত।

৫ জানুয়ারির ‘একতরফা নির্বাচন’ বর্জনকারী নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকেই এই ঐক্যে শামিল করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই