রাজধানীর মাত্র ২ শতাংশ বর্জ্য পানির সঠিক নিষ্কাশন হয়

তরল শিল্প-বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি স্থাপন ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকলেও দেশের অধিকাংশ শিল্প-কারখানায় তা মানা হচ্ছে না। উৎপাদিত তরল বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি ফেলা হচ্ছে খাল-বিলে, নদী-নালায়।

ঢাকা ওয়াসার দাবি, রাজধানীতে যে পরিমাণ বর্জ্য পানি হচ্ছে তার ২০ শতাংশ কভারেজ হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা মাত্র ২ শতাংশ সঠিকভাবে করা হচ্ছে বলে দাবি পরিবেশবিদদের। এর সঙ্গে রয়েছে রাজধানীর সুপেয় পানির সংকট এবং পানিবাহিত রোগের কারণে নাগরিক ভোগান্তি। এই অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ঢাকায় যে পরিমাণ বর্জ্য পানি হচ্ছে তার ২০ শতাংশ কভারেজ বললেও মূলত ২ শতাংশ সঠিকভাবে করা হচ্ছে। এসডিজি অর্জন করতে হলে পানি ও বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনার উপর জোর দিতে হবে।

তিনি বলেন, বিশ্বের ৭ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র ২.৪ বিলিয়ন মানুষ স্যুয়ারেজ সিস্টেম ব্যবহার করে। এর সিংহভাগ উন্নত দেশগুলোতে। আমাদের দেশে স্যুয়ারেজ সিস্টেম নেই বললেই চলে।

এবারের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনা’। কিন্তু রাজধানীর বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনার অবস্থা শোচনীয় বলে অভিযোগ রয়েছে পরিবেশবাদীদের।

তাদের মতে, বাংলাদেশে শিল্প কলকারখানার পানি দূষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দূষিত পানিতে বিভিন্ন রকমের ভাইরাস, জীবানু, ব্যাকটেরিয়াসহ নানাবিধ ক্ষতিকর জীবানু থাকে। এগুলো মুক্ত করতে হবে। তা না হলে নাগরিকরা এ পানি ব্যবহারের ফলে রোগাক্রান্ত হবেন। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বেন, পরিবেশ দুষিত হবে, এমনকি উৎপাদনও কমবে। তাছাড়া দেশ অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত হতে পারে।

কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি, শিল্প, খাদ্য, শক্তিসম্পদ সেক্টরসহ সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে পানির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পানি নিয়ে কাজ করা কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে, বৈশ্বিকভাবে ৮০ ভাগ পানি দূষিত হয়ে পরিবেশে চলে যাচ্ছে। যা একদিন ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। পৃথিবীর ১৮ বিলিয়ন মানুষ অপরিশোধিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা সুপেয় ও দূষনমুক্ত পানি পাচ্ছে না। ৬৬৩ মিলিয়ন মানুষের নির্দিষ্ট কোন পানির উৎস নেই। বৈশ্বিকভাবে ৫০ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করে। পৃথিবীর মাত্র ৫৫ টি দেশে বর্জ্য পানি ব্যবস্থাপনা রয়েছে। অন্য কোন দেশের এ বিষয়ে কোনো তথ্যও নেই। বাংলাদেশও এর মধ্যে পড়ে। দুঃখের বিষয় বর্জ্য পানির মাত্র ৯২ শতাংশ আন-ট্রিটেটেড হয়ে থাকে। তার জন্য পরিবেশের অনেক বেশি দূষণ ঘটে।

ঢাকা ওয়াসা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান গতকাল মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সম্পুর্ণ ঢাকা শহরকে ২০২৫ সালের মধ্যে পাইপ লাইন সুয়ারেজের মধ্যে আনার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তারা।

তিনি দাবি করেছিলেন, ঢাকা শহরে পানির সমস্যা সমাধানে ২০১০ সালে গৃহীত তিনটি ওয়াটার মাস্টার প্লানই তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, রাজধানীর পানি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে স্যুয়ারেজ, ওয়াটার এবং ড্রেনেজ মাষ্টার প্লান করা হয়। আমরা আশা করছি, আগামী আট বছরের মধ্যে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

তবে সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও কঠিন চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট পলিসি অনেক পুরানো। একে আধুনিক করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনা নীতিও জরুরী। সেই সাথে সব স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ও বিশেষ প্রয়োজন। তারা বলছেন, এসব অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম। সেক্ষেত্রে ২০২৫ সালের মধ্যে পুরো রাজধানীকে পাইপলাইন স্যুয়ারেজের মধ্যে আনা অনেকটাই অকল্পনীয়।

দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ড. দিবালোক সিংহ বলেন, দূষিত পানির কারণে জনস্বাস্থ্য দিনে দিনে হুমকির মুখে পড়ছে। দেশে ৩৩ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতি ও ওজন কমের শিকার। এছাড়া আমাদের পরিবেশ, পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার পানি সরবরাহের প্রধান উৎস ছিল চার নদী। বর্তমানে এই চার নদী এত পরিমাণে দূষিত যে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যে নেমে গেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকার প্রাণ বলে পরিচিত বুড়িগঙ্গার পানি সারাবছরই ব্যবহার অনুপযোগী থাকছে। পানি ব্যবহারের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি মিলিমিটারে ৫-এর উপরে থাকা জরুরি হলেও ঢাকার চার নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ১ থেকে দশমিকের নিচে অবস্থান করছে। ওয়াসা বলছে, একারণে নদীর পানি ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পরিশোধন করা যাচ্ছে না। এমনকি নদীর পানিতে ভারী ধাতব পদার্থের উপস্থিতিরও প্রমাণ পাওয়া গেছে।

জানা যায়, প্রতিদিন ঢাকার প্রাণ শুধু বুড়িগঙ্গা নদীতেই ৯০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি বেজলাইন সার্ভে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার শ্যামপুরে দুটি ইউনিটে ৬৩টি প্রিন্টিং ও নিট ডায়িং কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি কারখানার নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার আছে। বাকি ৫৯টি কারখানা প্রতিদিন ২৫ হাজার ৫৮২ ঘনমিটার তরল অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্ষতিকর সিসা, পারদ, সালফার ডাইঅক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড।



মন্তব্য চালু নেই