প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফেনীর পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষণ

যৌতুক না দেওয়ায় নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার মেধাবী ছাত্রী বর্ণা ॥ মামলা হলেও গ্রেফতার হয়নি আসামীরা

যৌতুক না দেওয়ায় নোয়াখালীর মেধাবী ছাত্রী বর্ণাকে ফেনীর শ্বশুর বাড়ীতে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু থানায় মামলা করা হলেও আসামীরা এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি। যৌতুক লোভী স্বামী মৃনাল কান্তি সরকার, শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হরেন্দ্র সরকার, শ্বাশুড়ী বকুল সরকার সহ শ্বশুর বাড়ীর লোকজন ১০ লক্ষ টাকা যৌতুক না পেয়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী বর্ণা দে (২৪) কে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করেছে বলে নিহতের পরিবারের লোকজন অভিযোগ করে।

এ বিষয়ে ফেনী মডেল থানায় স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ী সহ ৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়েরের পরও আসামীরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বর্ণার পরিবারের লোকজনকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। ফেনীর পৌরসভার তুলাবাড়ীয়া এলাকার শাহ বাড়ী সংলগ্ন শ্বশুর বাড়ীতে ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১০টার দিকে বর্ণা দে কে শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার পর স্বামীর শয়ন কক্ষের সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখে।

ওই দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে নিহতের পরিবারের লোকজন স্থানীয় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খবর পায় বর্ণা দে স্বামীর বাড়ীতে মারা গেছে। এর আগেই নিহত বর্ণার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা থানা পুলিশে খবর দেয় মৃতদেহ উদ্ধারের জন্য। যৌতুকের লোভে বলি হওয়া নিহত বর্ণা দে নোয়াখালী সদর উপজেলার মাইজদীর নতুন জেলখানা রোড এলাকার বলাই বাবুর বাড়ীর বলাই চন্দ্র দে’র মেয়ে। মেধাবী বর্ণা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে ফার্মেসী বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরআগে ২০১১ সালে একই বিষয়ে অনার্সেও তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। তিনি এসএসসি ও এসএইচসিতেও জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। মেধাবী বর্ণা ২০০৪ সালে জিপিএ-৫ সর্বোচ্চ ফলাফল করায় নোয়াখালী-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহন করেন। মৃত্যু আগে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর নোবিপ্রবি’র ১ম সমাবর্তণ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করেন।

নিহত বর্ণার বড় ভাই স্বপন কুমার দে হত্যার অভিযোগ করে বলেন, ১নং আসামী ফেনীর জেলার পৌরসভার তুলা বাড়ী এলাকার হরেন্দ্র সরকারের ছেলে মৃনাল কান্তি সরকারের সাথে আমার ছোট বোন বর্ণা দে’র সাথে পড়াশোনার পরিচয়ের সূত্রে সম্পর্কের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মীয়ভাবে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের পর তার শ্বশুর ও শ্বাশুড়ী এ বিয়েকে স্বাভাবিকভাবে মেনে না নিয়ে আমার বোন বর্ণার উপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকে।

বিয়ের পর বোনের সুখের কথা চিন্তা করে আমরা ৭ ভরি স্বর্ণালংকার, টিভি, ফ্রিজ, সোফাসেট, বঙ্খাট, আলমিরা সহ ৫-৬ লক্ষ টাকার দামি মালামাল দিই। এরপর শ্বশুর-শ্বাশুড়ী পাকা ভবন নির্মাণের জন্য ধার হিসেবে ৮ লক্ষ চাইলে আমার বাবার চাকুরী থেকে এককালীন প্রাপ্ত ২৫ লক্ষ টাকা থেকে নগদ ৮ লক্ষ ধার দিই। একপর্যায়ে যৌতুক লোভী শ্বশুর শ্বাশুড়ী ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে আমাদের কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা যৌতুক এনে দেওয়ার জন্য আমার বোন বর্ণার উপর চাপ দিতে থাকে। আমরা এতো টাকা দিতে সামর্থ নয় বলে জানাইলে তারা আমার বোনের উপর পুনরায় বিভিন্ন সময়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকে।

অমানবিক এ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এসময় আমার বোন আমাদের বাড়ীতে চলে আসে। পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে ১নং আসামী মৃনাল কান্তি সরকার বর্ণাকে মোবাইল ফোনে তাদের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বলে। আমার বোন স্বামী সংসার করার জন্য ফেনীর শ্বশুর বাড়ীতে চলে যায়। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর আমার বোন কান্নাজড়িত কন্ঠে মোবাইল ফোনে আমাদের জানায় দাবিকৃত যৌতুকের ১০ লক্ষ টাকার জন্য তার স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সহ পরিবারের লোকজন তার উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে।

পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমরা স্থানীয় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খবর পাই আমার বোন বর্ণা দে মারা গেছে। খবর পাওয়ার পরপরই আমরা ফেনীর তুলা বাড়ী এলাকার বর্ণার শ্বশুর বাড়ীতে গিয়ে তাকে তার স্বামীর শয়ন কক্ষের সিলিংফ্যানের সাথে আধা ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পাই। সেখানে উপস্থিত লোকজন ও প্রতিবেশীরা আমাদের জানায়, যৌতুকের টাকা না পেয়ে স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ী সহ পরিবারের লোকজন রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে আমার বোন বর্ণাকে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যার পর মৃতদেহ সিলিংফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখে।

2525
যৌতুক লোভী স্বামী মৃনাল কান্তি সরকার

এরআগে বর্ণার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হরেন্দ্র সরকার পুলিশে খবর দিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে বাড়ীতে পালিয়ে যায়। বাড়ীতে ছিলেন শুধুমাত্র বর্ণার শ্বাশুড়ী বকুল সরকার। তাও পুলিশের অনেক ডাকাডাকির পর তিনি মশারীর ভিতর থেকে উঠে আসেন। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি উপস্থিত লোকজনের সামনে বলেন এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তার ছেলে মৃনাল কান্তি সরকার সব জানে। পরে পুলিশ আমার বোনের সুরুতহাল রিপোর্ট তৈরী করে ময়নাতদন্তের জন্য ফেনী সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরন করে।

এদিকে বর্ণার একসময়ের সহপাঠী বান্ধবী আমার স্ত্রী তুলি দে তার ননদ বর্ণার এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অকালে বান্ধবী বর্ণাকে হারিয়ে তুলি দে এখনো খাওয়া-দাওয়া ভুলে শোকাহত অবস্থায় আছে। এখনো মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে পারছেনা সে সহ আমাদের পরিবারের লোকজন। ঘটনার পর আমি নিজে বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় বর্ণার স্বামী মৃনাল কান্তি সরকার, শ্বশুর হরেন্দ্র সরকার, শ্বাশুড়ী বুকল সরকার সহ ৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জনের বিরুদ্ধে (মামলা নং-৩৪, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর সংশোধনী/০৩ এর ১১(ক)/৩০ ধারা) যৌতুকের দাবীতে নির্যাতন করিয়া হত্যা ও সহযোগিতা করার অপরাধে একটি মামলা দায়ের করি। যার জি.আর- ৬৫৩/১৪।

এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে বর্ণার মামা শ্বশুর দেবাশীষ সরকারকে গ্রেফতার করে। অন্য আসামীরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসামীরা প্রভাবশালীদের যোগসাজশে প্রভাব খাটানো ও কোনো রহস্যজনক কারণে দীর্ঘ ৪ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও বর্ণার ময়নাতদন্তের রিপোর্টটি আদালতে জমা দেওয়া হয়নি।

এদিকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া দেবাশীষ সরকার হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে অন্য আসামীরা সহ ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে আমাদের পরিবারের লোকজনকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে। আমরা পরিবারের লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ফেনীর পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমরা যৌতুকের জন্য এ হত্যার সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকারী আসামীদের গ্রেফতার ও শাস্তি দাবী জানাচ্ছি।

ফেনী মডেল থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বেলাল উদ্দিন এ প্রতিবেদককে মামলার বিষয়ে জানান, এ মামলা এজাহারের পরও বাদী পক্ষ থেকে একটি সম্পূরক এজাহার আসে। তবে মামলার উল্লেখিত আসামীদের গ্রেফতারে জোর অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই