যে ৮ শিল্পের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত

জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন মেসোথেলিওমা (ক্যান্সার) ও অ্যাসবেসটোসিস বাশ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যায়। ডার্মাটাইটিস, স্ক্যাবিজ ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনে ভোগেন চামড়া ও রি-রোলিং মিলের শ্রমিকরা।

ধূলিকণার কারণে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হন জাহাজ ভাঙা ও রসায়ন শিল্পের শ্রমিকরা। নিরাপদ স্যানিটারি ব্যবস্থার অভাবে নানা ধরনের স্ত্রীরোগজনিত সমস্যায় ভুগতে হয় নির্মাণ খাতের নারী শ্রমিকদের। আর আর্দ্র পরিবেশে কাজ করার কারণে দীর্ঘমেয়াদি ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভোগেন চিংড়ি শিল্পের শ্রমিকরা।

সম্প্রতি দেশের শিল্প খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিরূপণে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে পেশা ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা বৃত্তান্তের (অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি প্রোফাইল) খসড়া। তাতে উঠে এসেছে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের দুরারোগ্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার এ চিত্র।

সব খাতেই কমবেশি এ সমস্যা থাকলেও অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতগুলো হলো— নির্মাণ, চামড়া, চিংড়ি, রি-রোলিং, পাট, ক্ষুদ্র রসায়ন, জাহাজ ভাঙা ও তৈরি পোশাক শিল্প।

অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি প্রোফাইল তৈরিতে সংশ্লিষ্ট শিল্পের শ্রমিকদের সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছে। এছাড়া অগ্রাধিকার বিবেচনায় নেয়া খাতগুলো সরেজমিন পরিদর্শনও করা হয়েছে। শ্রমিকের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে এটি তৈরি করা হয়েছে।

আলোচ্য আটটি খাতে কর্মরত ৫০ লাখের বেশি শ্রমিক। এর বড় অংশই তৈরি পোশাক খাতের। অকুপেশনাল হেলথ সেফটি প্রোফাইল অনুযায়ী, কাজ করার সময় যেসব নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেয়ার কথা, তাতে ঘাটতি থাকায় মূলত এসব খাতের শ্রমিকরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিনের (নিপসম) পেশা ও পরিবেশ স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউল ইসলাম (পিএইচডি) বলেন, দেশের বিভিন্ন খাতে পেশাগত ও স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। পোশাক খাতে ডাস্টের কারণে শ্রমিকদের শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসনালির প্রদাহজনিত রোগ হতে পারে। যেসব শ্রমিক ডায়িং কারখানায় কাজ করেন, তাদের স্কিন ক্যান্সারসহ মূত্রথলির ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে। সিলিকা নিয়ে কেউ কাজ করলে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারেন।

তিনি বলেন, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মধ্যে কাজ করার কারণে কানের সমস্যা থেকে শুরু করে মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো অসংক্রামক রোগ যেমন— ক্যান্সার, হাঁপানি নিয়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবচেয়ে জরুরি মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সচেতনতা। এ অবস্থায় প্রতিরোধ উপকরণ জোগান ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি নীতিমালার আলোকে পুরো বিষয়টি সমন্বয় ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

দেশের শ্রমঘন সবচেয়ে বড় শিল্প খাত তৈরি পোশাক শিল্প। খাতটিতে নিয়োজিত শ্রমিক সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ধূলিকণার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসনালির প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন এ খাতের শ্রমিকরা।

পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ডায়িং কারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাদের স্কিন ক্যান্সারসহ মূত্রথলির ক্যান্সার ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অভাবে বিভিন্ন স্ত্রীরোগজনিত সমস্যায় ভুগতে হয়। আবার দীর্ঘসময় বসে বা দাঁড়িয়ে কাজের অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে শরীরে ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে একসময় লক্ষাধিক শ্রমিক (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে) কাজ করলেও শিল্পটির মন্দায় এখন তা ৩০- ৩৫ হাজারে নেমে এসেছে। যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ব্যবহারে সচেতনতার অভাব রয়েছে এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যে। ফলে উচ্চ ও মধ্যম মাত্রার রোগের ঝুঁকিতে পড়ছেন তারা। আক্রান্ত হচ্ছেন মেসোথেলিওমা (ক্যান্সার) ও অ্যাসবেসটোসিস বা শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যায়।

ভাটিয়ারীর একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ওয়েল্ডিংয়ের সময় সৃষ্ট ধোঁয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া দূষিত তেল ও জাহাজের প্লেটের ওপর উচ্চ তাপমাত্রার শিখা জ্বালানোর কারণে হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগে ভুগতে হয়।

বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পাট শিল্পে কাজ করেন দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। সরকারি-বেসরকারি খাতে আসা-যাওয়া ও লোকসানের কারণে এ খাতের বহু শ্রমিক ঝরে পড়েছেন। এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যে শ্বাসনালির সংক্রমণ, চর্মরোগ ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এসব রোগের উচ্চ ও মধ্যম মাত্রার ঝুঁকি বহন করেন এ খাতের শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ ম্যানুফ্যাকচারিং সার্ভের তথ্য অনুযায়ী মৌলিক আয়রন এবং স্টিল বা রি-রোলিং খাতে কাজ করেন লক্ষাধিক শ্রমিক। এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যেও রয়েছে উচ্চ ও মধ্যম মাত্রার শ্বাসনালির সংক্রমণ, চর্মরোগ ও অ্যাজমার মতো রোগ।

চামড়া পুড়ে যাওয়া, ডার্মাটাইটিস, স্ক্যাবিজ ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনও বেশি দেখা যায় এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যে।

তথ্যমতে, মৌলিক রসায়ন শিল্পে কর্মরত প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক। এ খাতের শ্রমিকদের মধ্যেও উচ্চ ও মধ্যম মাত্রার শ্বাসনালির সংক্রমণ, চর্মরোগ ও অ্যাজমার ঝুঁকি রয়েছে। অতিমাত্রায় ধুলা অ্যালার্জি ও ব্রঙ্কাইটিস ঝুঁকিতে ফেলছে রসায়ন শিল্পের শ্রমিকদের।

দেশে হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ দেশের শতভাগ কৃষিভিত্তিক ও রফতানিমুখী শিল্প খাত। চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ উত্পাদন, বিপণন, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ ও রফতানিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় দেড় কোটি মানুষ।

চিংড়ি কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের হাতে গ্লাভস ও পায়ে জুতা পরে কাজ করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। সারা বছর আর্দ্র পরিবেশে এভাবে কাজ করার কারণে দীর্ঘমেয়াদে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় ভোগেন এ খাতের শ্রমিকরা।

খুলনার একটি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানায় কাজ করেন মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, চিংড়ি যখন কারখানায় আসে, তখন বরফ কক্ষে এক নাগাড়ে কাজ করতে হয়। এতে ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন সমস্যা ছাড়াও মাথাব্যথায় ভুগতে হয় তাদের।

পেশাগত ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মন্তব্য করেন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমেদ। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে পেশাগত ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে সংস্থার সামর্থ্য বাড়ানো প্রয়োজন।

ওএসএইচ প্রোফাইলে এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এ-সংশ্লিষ্ট আরো মতামত সমন্বয় করা হবে। প্রোফাইলের আলোকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পেশাগত ও স্থ্যনিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি কমিয়ে আনতে হবে। এ উদ্যোগ সরকারের রয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশের শিল্প খাতের সর্বশেষ ওএইচএস বৃত্তান্ত তৈরি হয় ২০০২ সালে। বর্তমানে শিল্প খাত যেমন বেড়েছে, তেমনি পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে পেশাগত ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও পরিবর্তন এসেছে। এ কারণেই সরকার নতুন ওএইচএস বৃত্তান্ত তৈরি করছে। সূত্র: বনিক বার্তা।



মন্তব্য চালু নেই