যে পাহাড় আজও জয় করতে পারেনি মানুষ!

পৃথিবীতে কত-শত পাহাড় রয়েছে তার হিসেব খুব একটা সহজ নয়। আমাদের সমতলভূমিপ্রধান বাংলাদেশের দিকে তাকালেই ব্যাপারটি দিনের আলোর মতন পরিষ্কার হয়ে যায়। বাংলাদেশ বাদেও পৃথিবীতে রয়েছে ভূটান, নেপাল, রাশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, অ্যান্টার্কটিকাসহ শত-শত দেশের হাজারো পাহাড়। এর কয়টাতে উঠেছে মানুষ? বিশেষ করে যেখানে বর্তমান প্রজন্মের কাছে আন্তর্জালিক দুনিয়াটাই সবচাইতে বড়? ইন্টারনেটে কোন একটা তথ্য নেই মানে সেটার যেন কোন উপস্থিতিই নেই! এমনটাই হয়ে গিয়েছে বর্তমানে মানুষের মস্তিষ্কের গঠন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? একজন অভিযাত্রীকের কাছে সবচাইতে আনন্দময় আর উত্তেজনাকর সংবাদটি হচ্ছে নতুন কোন পাহাড়ের সন্ধান। যাকে আজ অব্দি ছুঁতে পারেনি কেউ।

সেই ১৮৫০ সাল থেকে পাহাড়ে চড়ার খেলাটা প্রচন্ডরকম গতি পেতে শুরু করলে প্রত্যেকেরই লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় নতুন কোনো পাহাড় জয় করে নিজের নাম ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া। সেটায় আরো একটা বিশাল মাত্রা যোগ করে তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারী। ১৯৫৩ সালে সবচাইতে উঁচু পাহাড় হিসেবে খ্যাত হিমালয়কে পার করে। এর পর একের পর এক পাহাড় জয় করতে থাকে মানুষ। গড়তে থাকে রেকর্ড। কেউবা সবচাইতে কম বয়সে পাহাড় জয় করে ( মাত্র ১৩ বছর বয়সে ), কেউবা ভিন্ন আর দূর্ধর্ষ পথে জয় করা পাহাড়ই আবার জয় করে, আবার কেউ প্রচণ্ড শীতে কিংবা দড়ি বা অন্যকোন সাহায্য ছাড়াই পাহাড় জয় করে। কি করেনি মানুষ নতুন করে কিছু একটা করতে, নিজেকে স্মরনীয় করে রাখতে? কিন্তু এসবই তারা করেছে আর চড়ার মতন নতুন কোন পাহাড় না পেয়ে।

কিন্তু আসলেও কি বাস্তবতা তাই? শেষ হয়ে গিয়েছে অজেয় পাহাড়? পৃথিবীর কি আর কোন পাহাড় নেই যেটা আজ অব্দি পার করেনি কোন মানুষ? যেটার চূড়ায় এখন পর্যন্ত পড়েনি মানুষের পা? আছে! ৬৫টি নতুন পাহাড় অতিক্রমকারী এবং মাউন্ট এভারেস্ট ফাউন্ডেশন স্ক্রিনিং কমিটির চেয়ারম্যান গ্রিফিনের মতে বর্তমানে জয় করে নেওয়া পাহাড়ের চাইতে পৃথিবীতে এমন পাহাড়ের সংখ্যাই বেশি যেগুলোতে এখনও চড়েনি মানুষ।

পৃথিবীর বিশালতা বোঝাতে গিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে গ্রিফিন বলেন, ‘বিশাল এই পৃথিবী।’ তাহলে? তাহলে কেন কেউ নতুন কোনো পাহাড় জয় করছে না? কেন একই পাহাড়ের পেছনে বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা? অনেকের মতে এর পেছনে রয়েছে নানারকম কারণ। কোনটার ক্ষেত্রে সেটা রাজনৈতিক, কোনটার ক্ষেত্রে ভূ-প্রকৃতিক। আর কোনো কোনো পাহাড়ে মানুষকে একরকম নিষিদ্ধই করে দেওয়া হয়েছে। আর এসব কারণেই বর্তমানে মানুষ নতুন কোন পাহাড় খুঁজে পাচ্ছে না চড়ার জন্যে। আবার এ ব্যাপারটির রয়েছে পুরো ভিন্ন একটা দিকও। কি মনে হয়? ঠিক কতদিন ধরে এভাবে কে কোনো পাহাড়ে প্রথম চড়ছে সেটা রেকর্ড করা হচ্ছে? নিশ্চয় খুব একটা বেশিদিন নয়? কারণ এর আগে কেউ পাহাড়ে চড়ে থাকলেও সেটা সে করেছে জীবনের তাগিদে বা আনন্দের জন্যে। এটাও যে কোথাও জানানো দরকার মনে হয়নি কারো।

আর যদি রেকর্ড থেকেও থাকে তাহলেও চলে আসে এর সত্যি-মিথ্যের ব্যাপারটা। তখনকার সময়ে এতটা ভালো প্রযুক্তি ছিল না কারো কাছে।

ফলে ছবি বা কোন প্রমাণ- কিছুই দেওয়া সম্ভব ছিল না। আর ভয়ংকর রকমের কঠিন কোন পাহাড়ে কেউ চড়েছে কিনা সেটা তদন্ত করার জন্যে অতটা ওপরে ওঠার ঝুঁকি নেওয়ার মানুষও ছিল না। আর তাই কেউ যদি কোনো পাহাড়ে প্রথমে ওঠে তাকে এবং সেটার রেকর্ড করে তাতেও সে সত্যিই সেটাতে চড়েছে কিনা তা প্রমাণ হয় না। গাঙখার পুয়েনসাম বর্তমানে সবাই চায় প্রমাণ। প্রমাণ ছাড়া কোনকিছুরই মূল্য থাকে না।

এছাড়াও যেমনটা আগেই বলা হয়েছে যে বর্তমানে মানুষ সবচাইতে বেশি নির্ভর করে ইন্টারনেটের ওপর। কে, কখন, কোন পাহাড়ে চড়েছে তার সবটা ইন্টারনেটে লিপিবদ্ধ নেই। বিশেষ করে একবার চড়ে ফেলা পাহাড় যে আসলেই জয় করা হয়েছে সেটা নিয়েও পুরো তথ্য পাওয়া যায় না কখনো কখনো। আর তাই নতুনদের অনেকের মনেই দ্বন্ধ ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তারা উঠে পড়ে সেই পুরোন পাহাড়েই। কিন্তু এতকিছুর পরেও অভিযাত্রীকদের জন্য চমৎকার একটি সংবাদ হচ্ছে তাদের জন্যে বর্তমানেও অনেকগুলো পাহাড় রয়েছে পৃথিবীতে। যেগুলো আনকোরা নতুন যা ধরা-ছোঁয়ার ভেতরেই। আর এই পাহাড়গুলোর ভেতরে সবচাইতে উঁচু পাহাড়টির নাম হচ্ছে ভূটানের টিবেটান সীমান্তের ৭,৫৭০ মিটার উঁচু গাঙখার পুয়েনসাম। যেটাতে যুগের পর যুগ ধরে মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে চড়ার।

১৯৯৪ সাল কথা। একটা অভিযাত্রী দল গাঙখারে চড়তে চড়তে ৬০০০ মিটার উপর অব্দি চলে যায়। চূড়ার অনেক কাছে ছিলেন তারা তখন। আর সেসময়ই তাদেরকে থামিয়ে দেয় ভূটানের মানুষেরা। হিমালয়কে নিয়ে নেপালের অবস্থাকে দেখে কুসংস্কাকাচ্ছন্ন ভুটনের মানুষ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। পাছে তাদের কোন ক্ষতি হয় এই ভেবে এই পাশটায় না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

১৯৯৮ সালে আবার এক জাপানি দল চেষ্টা করে এটিকে জয় করার। সেবার রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার দেখিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয় তাদের। এই দলটির এক অভিযাত্রী পুরোপুরি সবটা না বললেও নিজেদের ব্যার্থতার কারণ হিসেবে ভুটানের রাজনৈতিক প্রভাবকে দায়ী বলে উল্লেখ করেন। তবে আসবার পথে এই দলটিই আরেকটি নতুন পাহাড় লিয়াঙ্কাঙ্গ কাঙ্গরি নামের ৭,৪৪১ মিটারের পাহাড়টি জয় করেন। তবুও পরে বিভিন্ন লেখায় নিজেদের আক্ষেপের কথা প্রকাশ করেন তারা।

আক্ষেপটা গাঙখারকে জয় না করতে পারার। মুচু ছিস তবে গাঙখার একাই নয়। এখন অব্দি সবার ধরা ছোঁয়ার কাছে রয়েছে আরেকটি আনকোরা পাহাড় যেটা কিনা যে কোন মুহূর্তেই জয় করে ফেলতে পারে মানুষ। আর এই পাহাড়টির নাম হচ্ছে মুচু ছিস। ৭,৪৫২ মিটার উচ্চতার অধিকারী এই পাহাড়টির অবস্থান গাঙখারের ঠিক পরপরই। বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম পাহাড় হিসেবে পাকিস্তানে দাড়িয়ে রয়েছে এটি। নানা কারণে আজ অব্দি এটি মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেলেও সম্প্রতি একজন অভিযাত্রীক ঘোষণা দিয়েছেন এটিকে জয় করার। আর সেটাই যদি হয় তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু আর আনকোরা নতুন পাহাড়ের তালিকায় সবার উপরে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকবে যে পাহাড়টি সেটি হচ্ছে গাঙখার। যদিও আরো অনেক পাহাড় অজেয় রয়েছে মানুষের। তবু গাঙখারই দাড়িয়ে থাকবে সবার প্রথম পছন্দ হিসেবে এ কথা এক পলকেই বলা যায়।



মন্তব্য চালু নেই