যে কারণে লেখক পরিমণ্ডলে অলেখক থাকাটা জরুরি

একটা দেশের সাহিত্য পরিমণ্ডলে প্রচুর অলেখক থাকেন। অলেখক বলতে সামগ্রিক অর্থে অকবি, অসাহিত্যিককে বোঝানো হচ্ছে, যারা কবি বা সাহিত্যিক হতে চান, কিন্তু বুদ্ধির মুক্তি না-ঘটাজনিত কারণে বা বোধ-বুদ্ধির স্বল্পতার কারণে হতে পারেন না, অথচ নিজেদের তারা প্রকৃত লেখক ভাবেন বা দাবি করে করেন। এদের থাকাটাকে আমি খুবই জরুরি বলে মনে করি। এরা আছেন বলেই প্রকৃত লেখকটি আছেন। এরা এমন একটি বৃত্ত তৈরি করে রেখেছেন, যে বৃত্তের মাঝখানে অবস্থান করেন লেখকটি। এরা অনেকটা সারের ভূমিকা পালন করেন, জমিনে যেমন উর্বরতার জন্য সার দেয়া হয়। সাহিত্যের জমিনে এরা সার। এরা না থাকলে লেখকটির বেড়ে ওঠাটা মুশকিল হয়ে পড়ত। এরা না থাকলে লেখকের বইটি কেনার মতো পাঠক খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ত। কেননা কৃষক বই পড়ে না, ব্যবসায়ী বা শ্রমিকও পড়ে না। পড়ে এই অলেখক শ্রেণিটি, যারা লেখক হয়ে উঠতে চান, যারা হরদম লেখক-পরিমণ্ডলে বিচরণ করেন এবং যারা লেখকের বইটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মশগুল থাকেন।

হোক বা না হোক এই অলেখকরা লিখে থাকেন, বইও প্রকাশ করে থাকেন। অর্থাৎ তারা সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্যেই আছেন। সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্যে না থেকে তারা সন্ত্রাসী চোরাকারবারীও হতে পারতেন। সৃষ্টিশীল চর্চার মধ্যে থাকার কারণে তাদের মধ্যে এমন এক শুভবোধের জন্ম হয়, যার কারণে মানবতার পক্ষে ক্ষতিকর এমন কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাদের বিবেকে বাধে।

প্রতিবছর বইমেলায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার বই বের হয়, যার বেশিরভাগই অলেখকদের বই। এই বিপুল বইয়ের প্রকাশকে আপনি নেতিবাচকভাবে দেখেন। আমি দেখি সম্পূর্ণ ইতিবাচকভাবে। আপনি কেন নেতিবাচকভাবে দেখেন? কারণ একটাই, বই প্রকাশের নামে অপচয় হচ্ছে। আপনার নেতিবাচকতার কারণ কিন্ত এই একটাই। অন্য কোনো কারণ নেই। আপনি অন্য কোনো কারণ দেখাতে পারবেন না।

আচ্ছা বলুন তো অপচয় কোথায় হচ্ছে না? একটি রাষ্ট্রের কথাই ধরুন। রাষ্ট্র নিজেই তো অপচয়কারী একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র পরিচালনার নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়ে যাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে মরণযন্ত্র আবিষ্কারের জন্য যে পরিমাণ অর্থের অপচয় হচ্ছে তার সিকিভাগের একভাগও তো এক বইমেলায় অপচয় হয় না। রাজধানী ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা বা ধানমণ্ডিতে প্রতিদিন যে পরিমাণ অপচয় হচ্ছে তা দিয়ে তো একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা আনয়ন সম্ভব। শহরের রাস্তায় এই যে শত শত প্রাইভেট কার চলছে তার মধ্যেও কি অপচয় কম? একটা মানুষকে, শুধু একটা মানুষকে বহন করার জন্য শত শত টাকার তেল পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। টেলিভিশনগুলোও কি অপচয় করছে না? দেশে এত এত টেলিভিশন, কয়টা দেখে মানুষ? প্রতিদিন এত এত পত্রিকা বেরুচ্ছে, কয়টা পড়ে মানুষ? এত এত রেডিও, কয়টা শোনে মানুষ?

তার মানে অপচয় সর্বত্র। আপনি এগুলোকে অপচয় বলছেন না, অথচ বই প্রকাশকে অপচয় বলছেন। একটি বই প্রকাশকে আপনি অপচয় বলবেন কোন যুক্তিতে? বইয়ের জন্য অপচয় হলে অসুবিধাটা কোথায়? অপচয়টা তো বইয়েরই জন্য, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তো নয়। মানুষ তার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে যত উপাদান আবিষ্কার করেছে বই তার মধ্যে প্রধান। হতে পারে বইটিতে আপনার পড়ার মতো কিছু নেই, কিন্তু কারো না কারো তো আছে। বইগুলো তো আর প্রকাশকরা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেন না। তার মানে কেউ না কেউ বইটি কেনে। কেউ না কেউ বইটি পড়ে। পড়ে তো অন্যায় কিছু করে না। প্রকাশিত ঐ বইটির মধ্যে সন্ত্রাসী হওয়ার কায়দা-কানুন তো লেখা থাকে না, সেটি পড়লে অন্যায় হবে কেন? আপনি বলতে পারেন, বই তো পড়ে না, এমনিই কেনে। অকারণে। লোক দেখানোর জন্য। কিন্তু লোক দেখানোর জন্য মানুষ তো বহু কিছু করে। সোনা-গয়না কেনে, বাহারি পোশাক কেনে, বিউটি পার্লারে যায়। আরো কত কিছুই তো করে। লোক দেখানোর জন্য বই কিনলে অসুবিধা কোথায়? এই কেনাকেনির মধ্য দিয়ে তো একটা বইসংস্কৃতি গড়ে উঠছে, নাকি?

অতএব, সার্বিক বিবেচনায় লেখক পরিমণ্ডলে অলেখকদের থাকাটাকে আমি গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করি। আপনি তাদের বিরোধিতা করে সাহিত্যের ক্ষতি করছেন, সৃষ্টিশীলতার ক্ষতি করছেন, সংস্কৃতির ক্ষতি করছেন। সর্বোপরি লেখক হিসেবে নিজের ক্ষতি করছেন।

স্বকৃত নোমান: কথাসাহিত্যিক



মন্তব্য চালু নেই